এক রাতেই বাংলা সংগীতের দুই নক্ষত্রের পতন, মুক্তিযুদ্ধের দুই সহযোদ্ধাকে হারালো বাংলাদেশ

বাংলা সংগীতের দুই দিকপাল সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও বাপ্পী লাহিড়ী আর নেই। মৃত্যুকালে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যারের বয়স ছিলো ৯০ আর বাপ্পী লাহিড়ী প্রয়াত হলেন ৬৯ বছর বয়সে।

মঙ্গলবার, ১৫ ফেব্রয়ারি দিবাগত রাতে মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে মারা যান বাংলা সংগীতের এই দুই নক্ষত্র।

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়

গত ২৭ জানুয়ারি ফুসফুসে সংক্রমণ নিয়ে  SSKM-এ ভর্তি হয়েছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।  সঙ্গে ছিলো শ্বাসকষ্ট। এরপর যখন করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে, তখন তাকে স্থানান্তরিত করা হয় শহরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে। কিছুদিনের মধ্যেও কোভিডমুক্তও হন তিনি। এমনকী, কোমরের ভাঙা হাড়ে অস্ত্রোপচারও হয়েছিল গত ১১ ফেব্রুয়ারি।

গত পরশু সোমবার রাত থেকেই শুরু হয়েছিল পেটে ব্যাথা, কমছিল রক্তচাপ। শারীরিক অবস্থা সংকটজনক হওয়ায় এদিন সকালে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে স্থানান্তরিত করা হয় আইসিইউতে। কিন্তু শেষরক্ষা হল না।

মঙ্গলবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধে ৭.৩০ নাগাদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। বর্ষীয়ান এই শিল্পীর মৃত্য়ুতে শোকের ছায়া নেমে আসে পুরো বাংলায়।

১৯৩১ সালের ৪ অক্টোবর কোলকাতায় জন্মগ্রহন করেন তিনি।

তার গাওয়া ‘এ শুধু গানের দিন, এ লগন গান শোনাবার’ বা ‘চন্দন পালংকে শুয়ে একা একা কী হবে’ বা ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ – এমন সব গান বাংলা আধুনিক গানের ইতিহাসে মাইল ফলক হয়ে থাকবে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধেও অবদান রেখেছেন তিনি। শরণার্থীদের জন্য হান গেয়ে অর্থ সংগ্রহ করেছেন। বাংলাদেশের জন্য বিশ্বব্যাপী সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করেন সন্ধ্যা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যেমন গান রেকর্ড করে দিয়েছিলেন তিনি, আবার শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে তিনি গেয়েছিলেন ‘বঙ্গবন্ধু তুমি ফিরে এলে তোমার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলায়’ গানটি।

আজ বুধবার, ১৬ ফেব্রুয়ারি রবীন্দ্রসদনে দুপুর ১২ টা থেকে বিকেল ৫ টা পর্যন্ত সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে শ্রদ্ধা জানাতে পারবেন অনুরাগীরা। এরপর শেষকৃত্য হবে কেওড়াতলা মহাশ্মশানে।

বাপ্পী লাহিড়ী

গত বছর এপ্রিল মাসে তাঁর করোনা ধরা পড়ে। সেই সময় মুম্বইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন বাপ্পি লাহিড়ি। কিছুদিন পর সুস্থ হয়ে বাড়িও ফেরেন। মঙ্গলবার মধ্যরাতে ‘অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া (ওএসএ)’-তে আক্রান্ত হয়ে মুম্বইয়ের ক্রিটিকেয়ার হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, গত প্রায় একমাস তিনি বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার জন্য হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। কিছুটা সুস্থ হয়ে সোমবারই বাড়ি ফেরেন বাপ্পি। কিন্তু মঙ্গলবারই ফের অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। পরিবারিক চিকিৎসক তাঁকে ফের ক্রিটিকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হতে বলেন।

মঙ্গলবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে সেই হাসপাতালেই তাঁর মৃত্যু হয়।

১৯৫২ সালের ২৭ নভেম্বর জলপাইগুড়িতে জন্মগ্রহণ করেন বাপ্পি লাহিড়ী।

১৯৭০ থেকে ৮০-এর দশকে হিন্দি ছায়াছবির জগতে অন্যতম জনপ্রিয় নাম বাপ্পি লাহিড়ি। বলিউডে ‘ডিস্কো ডান্সার’, ‘চলতে চলতে’, ‘শরাবি’, বাংলায় ‘অমর সঙ্গী’, ‘আশা ও ভালবাসা’, ‘আমার তুমি’, ‘অমর প্রেম’ প্রভৃতি ছবিতে সুর দিয়েছেন। গেয়েছেন বহু জনপ্রিয় গান।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তৈরি হওয়া দেশাত্মবোধক গান ‌’হাজার বছর পরে আবার এসেছি ফিরে বাংলার বুকে আছি দাঁড়িয়ে’ কমবেশি সবার চেনা। আবদুল জাব্বারের দরাজ কণ্ঠে অন্যরকম মাত্রা পেয়েছিল গানটি।

এই গানটির সুর করেছিলেন বাপ্পী লাহিড়ী, লিখেছেন প্রখ্যাত গীতিকার শ্যামল গুপ্ত। যিনি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের স্বামী।

২০২০ সালে তাঁর শেষ গান ‘বাগি- ৩’ এর জন্য। কিশোর কুমার ছিলেন বাপ্পির মামা। বাবা অপরেশ লাহিড়ি ও মা বাঁশরী লাহিড়ি- দু’জনেই সঙ্গীত জগতের মানুষ ছিলেন। একমাত্র সন্তান বাপ্পিও ছেলেবেলা থেকেই গানের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। মা, বাবার কাছেই পান প্রথম গানের তালিম। মা-বাবা নাম দিয়েছিলেন অলোকেশ, কিন্তু জনপ্রিয়তা পান বাপ্পি নামে।

সবসময় প্রচুর সোনার গয়না পরতে ভালবাসতেন। বলতেন, ‘আমার ভগবানের নাম সোনা!’  ছিল গায়কির নিজস্ব কায়দা, যা তাকে হিন্দি ছবির জগতে অনন্য পরিচিতি দিয়েছিল। সুত্র: আনন্দবাজার ও জি ২৪ঘন্টা।