মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের উপদেষ্টা, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ আর নেই। আজ শুক্রবার, ২৩ আগস্ট রাত সাতটা ৪০ মিনিটে রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে তিনি মারা যান। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৭ বছর।
তিনি ১৯৭১ সালের মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেছেন। ব্রিটিশ শাসনামল থেকে শুরু করে পাকিস্তান শাসনামল শেষে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন।
অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শোক জানিয়েছেন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ, বিএনটি ন্যাপসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা শোক জানিয়েছেন। মোজাফফর আহমদকে জন্মস্থান কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার এলাহাবাদে দাফন করা হবে বলে তাঁর একমাত্র কন্যা আইভী আহমদ সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন।
শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর শোক বার্তায় দেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে এই নেতার ভূমিকাকে স্মরণ করেন। তিনি বলেন, দেশের প্রগতিশীল রাজনীতিতে তাঁর অবদান জাতি চিরদিন মনে রাখবে।
অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ গত কয়েক বছর ধরে বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। এর মধ্যে কয়েক দফা তিনি রাজধানীর হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। সর্বশেষ গত ১৪ আগস্ট তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি হলে তাঁকে রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গত চার দিন ধরে তিনি সংকটাপন্ন অবস্থায় হাসপাতালটির নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে ছিলেন। শেষ সময় পর্যন্ত প্রবীণ এই বাম নেতা তাঁর একমাত্র মেয়ে আইভী আহমদের বাসায় থাকতেন।
১৯২২ সালের ১৪ এপ্রিল কুমিল্লা জেলার দেবীদ্বার উপজেলার এলাহাবাদ গ্রামে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের জন্ম হয়। চল্লিশের দশকে ‘পাকিস্তান উন্মাদনার’ বিপরীতে যে মুষ্টিমেয় মুসলমান তরুণ ছাত্রাবস্থায় বামপন্থায় দীক্ষা নিয়েছিলেন, মোজাফফর আহমদ তাঁদের একজন। ১৯৫১-৫২ সালে যখন ভাষা আন্দোলন হয়, তখন মোজাফফর আহমদ ঢাকা কলেজের শিক্ষক ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেও সেখানে বেশি দিন থাকেননি। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।
পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভার সদস্য হিসেবে মোজাফফর আহমদ স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে জোরালো ভূমিকা রাখেন। মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ১৯৫৭ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠিত হলে তিনি এর কেন্দ্রীয় নেতা হন। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হলে মোজাফফর আহমদের নামে হুলিয়া জারি হয় এবং তিনি আত্মগোপনে চলে যান। এর আগেই তিনি নিষিদ্ধ ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন। ১৯৬৭ সালে ন্যাপ বিভক্ত হলে মস্কোপন্থী অংশের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতির দায়িত্ব নিতে হয় তাঁকে।
মুক্তিযুদ্ধকালে মোজাফফর আহমদ মুজিবনগর সরকারে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনের পাশাপাশি বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে যোগ দিতে নিউইয়র্ক যান তিনি। মোজাফফর আহমদের সম্পাদনায় ‘নতুন বাংলা’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকাও প্রকাশিত হয়েছিল মুজিবনগর থেকে।
আশির দশকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালনকারী এই প্রবীণ রাজনীতিক ১৯৮১ সালে ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টি ও একতা পার্টির মনোনীত প্রার্থী হিসেবে রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন।
এবি/রাতদিন