রংপুর বিভাগে দুধর্ষ ইজিবাইক ছিনতাই চক্র! ৭ গডফাদারের বিশাল নেটওয়ার্ক ধরা

রংপুর ও দিনাজপুর অঞ্চলের ইজিবাইক চুরি-ছিনতাই চক্রের সন্ধান পেয়েছে পুলিশ। চক্রটির গডফাদার, দালাল এবং চোরদেরকে ইতোমধ্যে গ্রেফতারও করা হয়েছে। ৬ মাসের মধ্যে এই চক্রের হাতে ২ জন ইজিবাইক মালিক খুন হয়েছেন। ইজিবাইক চুরির ঘটনা ঘটেছে অর্ধশতাধিক।

পুলিশ জানায়, রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার বাবর আলীর ছেলে ওবায়দুল্লাহ্ ওরফে মোস্তফা (৫৫)। বর্তমানে সে রংপুর শহরের কেরানিপাড়ায় থাকে। শহরের বিনোদপুরে (রেলগেট) তার ‘রুবেল রিকন্ডিশন অটো সেন্টার’ রয়েছে।’ তার রিকন্ডিশন সেন্টারটিই ইজিবাইক মালিকদের সর্বনাশের মুল কেন্দ্র। রংপুর বিভাগের প্রায় সকল চোরাই ইজিবাইক ক্রয়-বিক্রয়ের কেন্দ্র এই অটো সেন্টারটি।

পাশাপাশি বিভাগের ইজিবাইক চুরি-ছিনতাইয়ে ৭ গডফাদারের মধ্যে ওবায়দুল্লাহ্ ওরফে মোস্তফাও একজন। অপর গডফাদারদের মধ্যে রংপুরের ৫ জন এবং দিনাজপুরের ১জন রয়েছেন। আর ওই গডফাদারদের নিয়ন্ত্রনে রয়েছে ৫০-৬০ জন চোরের একটি বিশাল নেটওয়ার্ক।

রংপুরের বিভিন্ন থানা সূত্রে জানা গেছে, গত ৬ মাসে অটো চুরির সময় দিনাজপুরেই ৩টি হত্যাকান্ড এবং ৫০ টির মতো অটো চুরি হয়েছে।

দিনাজপুরের বিরামপুর থানা সুত্রে জানা গেছে, ২৪ জুন রাতে বিরামপুরের হরিহরপুরের ২টি ইজিবাইক চুরির সময় দুর্বৃত্তরা নাসির উদ্দিন নামে এক ব্যক্তিকে হত্যা করে। ২৫ জুন নাসিরের ছেলে বাদী হয়ে থানায় অজ্ঞাতনামা আসামী করে হত্যা মামলা করে।

দিনাজপুরের বিরামপুর সার্কেলের এএসপি মিথুন সরকার ও মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা বিরামপুর থানার ওসি (তদন্ত) মতিয়ার রহমান প্রযুক্তি ব্যবহার করে যৌথ অভিযান চালিয়ে পার্বতীপুর উপজেলার উত্তর দরগাপাড়ার কফুল উদ্দিনের ছেলে মোজাহার, রংপুরের বদরগঞ্জের মকসেদপুরের মজিবুল হকের ছেলে জাহিদুল ও দিনাজপুরের ফুলবাড়ীর রামচন্দ্রপুরের আবুল হোসেনের ছেলে এবাদত ওরফে নয়ন ওরফে পিচ্চি (২৫) কে গ্রেপ্তার করে।

রিমান্ডে থাকা মোজাহার জানায়, হত্যাকান্ডে জাহিদুল, পিচ্চিসহ ৬ জন জড়িত। সে আরও জানায়, ঘটনার দুইদিন আগে নাসিরের বাড়ি টার্গেট করে অটো চুরির জন্য এবাদত, পিচ্চিসহ ৬ জনকে ডেকে আনে। এরমধ্যে মোজাহার, এবাদতসহ আরেকজন ২৪ জুন সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় বিরামপুর পৌর শহরের হাবিবপুর মোড়ে একত্রিত হয়। এরপর রিক্সাভ্যানে করে তারা ঘটনাস্থলে একটি বাঁশঝাড়ে লুকিয়ে থাকে।

রাত ১০ টার দিকে পিচ্চিসহ বাঁকি দুইজন ঘটনাস্থলে একত্রিত হয়। সেখান থেকে তারা পরিকল্পনা করে রাত ১২ টায় নাসিরের বাড়িতে ঢোকে। অটো চুরির সময় নাসির জেগে উঠলে দুর্বৃত্তরা তাকে বাঁশ দিয়ে মাথায় আঘাত করে হাত-পা বেঁধে বাড়ির পাশে জঙ্গলে ফেলে রেখে দুটি অটো নিয়ে যায়। দুটি অটোর মধ্যে জাহিদুল একটি, অপরটি হত্যাকান্ডে জড়িতরা নিয়ে যায়।

এদিকে এবাদত পুলিশকে জানায়, একটি অটো বদরগঞ্জের মোসলমাড়ি (গাছুয়াপাড়া) গ্রামের আব্দুর রশিদের ছেলে জিয়াউর রহমান ওরফে বাবুর মাধ্যমে বিক্রি করা হয়। পুলিশ ৬ জুলাই বাবুকে গ্রেপ্তার করে।

পুলিশ জানায়, এই বাবু মূলতঃ দালাল। সে চোরদের সাথে গডফাদারদের সমন্বয় করে দেয়। তাকে গ্রেপ্তারের পরেই রংপুর বিভাগের ইজিবাইক চুরি-ছিনতাইয়ের চক্রের সন্ধান পায় পুলিশ। তার দেয়া তথ্যে এএসপি মিথুন সরকারের নেতৃত্বে পুলিশ রংপুর শহরের বিনোদপুরে (রেলগেট) মোস্তফার ‘রুবেল রিকন্ডিশন অটো সেন্টার’ থেকে বিরামপুরের চুরি যাওয়া একটি ইজিবাইক উদ্ধার করে।

অপরদিকে আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে মোজাহার, জাহিদুল এবং এবাদত জানায়, রংপুর বিভাগে অটো চুরি এবং ছিনতাইয়ে ৭ গডফাদার রয়েছে। তারা হলো রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার ছড়ান গ্রামের আশরাফুল, সোহেল, জুয়েল, আমিনুল ও আমজাদ, গঙ্গাচড়া উপজেলার বাবর আলীর ছেলে ওবায়দুল্লাহ্ ওরফে মোস্তফা এবং দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার কুশদহ গ্রামের জাকির হোসেন। এ ছাড়াও ১৬ জুন নবাবগঞ্জে চালককে খুন করে একটি চার্জার ভ্যান লুট করা হয়।

বিরামপুর সার্কেলের এএসপি মিথুন সরকার জানান, তিন স্তরে ব্যাটারি চালিত ইজিবাইক চুরি হয়। প্রথমে গডফাদার, দ্বিতীয়ত দালাল এবং তৃতীয়ত সরাসরি চোর। গডফাদাররা দালালদের মাধ্যমে চোরদের নিয়ন্ত্রণ করে। দালালের মাধ্যমে চুরি হওয়া ইজিবাইকগুলো গডাফাদারের বাইরে যাবার কোন সুযোগ থাকে না। গডফাদাররা সবসময় ধরা ছোঁয়ার বাহিরে থেকে যায়।

তিনি আরও বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চুরি যাওয়া অটো উদ্ধারের পর বা অপরাধের জড়িত প্রাথমিক পর্যায়ের ব্যক্তিদের আটক করেই তদন্ত শেষ করেন। ফলে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক চুরি-ছিনতাই বন্ধ হয় না। তাই বিরামপুরের একাধিক হত্যার ঘটনায় এ চক্রের শেকড় উৎপাটনের লক্ষ্যে ব্যাপক অনুসন্ধান অব্যাহত রাখায় চক্রটি ধরা সম্ভব হয়েছে। এ চক্রের সকল গডফাদার এবং চোরদের দ্রæত আইনের আওতায় আনা হবে।

জেএম/রাতদিন