সাংবাদিক আরিফুলের বক্তব্য শুনতে চেয়েছেন হাইকোর্ট, সকল নথি তলব

অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি আরিফুল ইসলাম রিগ্যানকে মধ্যরাতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে গ্রেপ্তার ও কারাদণ্ড দেওয়ার ঘটনার যাবতীয় নথি তলব করেছেন হাইকোর্ট। আগামী ২৩ মার্চের মধ্যে তা দাখিল করতে রাষ্ট্রপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে ওই ঘটনায় সরকার কি পদক্ষেপ নিয়েছে তাও জানাতে বলা হয়েছে।

আদালত বলেছেন, রাষ্ট্রের বা সরকারের একজন ব্যক্তি বা একজন পদধারী যদি কোনো অন্যায় করে, সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র বা সরকার যদি তাকে সমর্থন না দেয় সেটাই হবে আইনের শাসন। আর সরকার বা রাষ্ট্র যদি ওই ব্যক্তির অন্যায় কাজে সমর্থন দেয় সেটা হবে আইনের লঙ্ঘন।

বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি সরদার মো. রাশেদ জাহাঙ্গীরের হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ সোমবার, ১৬ মার্চ এ আদেশ দেন। রিগ্যানকে গ্রেপ্তার ও দণ্ড দেওয়ার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দাখিল করা রিট আবেদনের ওপর আগামী ২৩ মার্চ পরবর্তী শুনানির জন্য দিন ধার্য করা হয়েছে। জনস্বার্থে বাংলা ট্রিবিউনের নির্বাহী সম্পাদক হারুন উর রশিদের করা এক রিট আবেদনে এ আদেশ দেন আদালত।

আদালতে রিট আবেদনকারীপক্ষে আইনজীবী ছিলেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট এ এম আমিনউদ্দিন, ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন ও অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল দেবাশিস ভট্টাচার্য।

শুনানিকালে রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল (ডিএজি) দেবাশিস ভট্টাচার্য বলেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিদর্শক জাহিদুল ইসলামের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আরিফুল ইসলাম রিগ্যানকে একবছর কারাদণ্ড, ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে ১৫ দিনের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আসামির বিরুদ্ধে। তাকে মাদক সেবনরত অবস্থায় টাস্কফোর্স আটক করে। তিনি আদেশের কপি পাঠ করার সময় ‘জনতার সামনে মাদকের ক্ষতিকর প্রভাবের বিষয়ে জনতার প্রতিক্রিয়া পর্যালোচনা করলাম’- এই অংশটুকু উল্লেখ করায় আদালত বলেন, একবার বলছেন, ‘দুইজন সাক্ষীর উপস্থিতিতে অপরাধ’, আবার বলছেন জনতার সামনে।

জবাবে ডিএজি বলেন, এ ঘটনার সময় উপস্থিত জনতার কথা বলা হয়েছে। তিনি বলেন, এই ফৌজদারি অপরাধের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট আবেদন করার সুযোগ নেই। তাছাড়া ক্ষতিপূরণ চাইতে হলে ভুক্তভোগীকেই আসতে হবে।

শুনানির এক পর্যায়ে আদালত রাষ্ট্রপক্ষের কাছে জানতে চান, খবরে শুনলাম, ভিকটিমের স্ত্রী বলছেন তারা কেউ জামিনের আবেদন করেননি। তাহলে আরিফুলের জামিন আবেদন কে করল? জবাবে ডিএজি বলেন, ২৫ হাজার টাকা মুচলেকায় জামিন হয়েছে বলে নথিতে দেখছি।

আদালত বলেন, জামিননামায় কে স্বাক্ষর করেছে? আসামি যদি জামিন নিতে না চান তাহলে কি আদালতের জামিন দেওয়ার সুযোগ আছে? জবাবে ডিএজি বলেন, এ বিষয়েতো কোনো নথি নেই। হয়তো আপিল করেছে আসামি! এ সময় অ্যাডভোকেট আমিন উদ্দিন বলেন, আসামি যদি দোষ স্বীকার করেই তবে তো তার আর আপিল করার সুযোগ নেই।

এ সময় আদালত বলেন, কেউ যদি অপরাধ স্বীকার করে তবেতো তার আর আপিল করার সুযোগ থাকে না। আইনেই সেটা স্পষ্ট উল্লেখ করা আছে। তাহলে আপিলে জামিনের আবেদন করে কিভাবে? এ সময় আমিন উদ্দিন বলেন, বেআইনিভাবে মধ্য রাতে দরজা ভেঙে সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সাজা দেওয়া হয়েছে। একইভাবে বেআইনি প্রক্রিয়ায় তাকে জামিন দেওয়া হয়েছে।

শুনানিতে এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, সাংবাদিককে রাত পৌণে ১২টায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি বলেন, কোনো সভ্য দেশে দরজা ভেঙে এভাবে কাউকে গ্রেপ্তার করা হয় না। তাও একজন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই সাংবাদিক এর আগে জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে অনিয়মের রিপোর্ট করেন। রিপোর্ট করা কি অপরাধ? তিনি বলেন, সংবাদপত্র হলো সমাজের দর্পণ। সাংবাদিকরা জেগে থাকে বলেই সমাজে অপরাধ কম হয়।

এ সময় আদালত বলেন, সংবাদপত্র হলো রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। এটা যদি ঠিকমতো কাজ করে তবে রাষ্ট্রের বাকী তিনটি অঙ্গ ঠিকমতো কাজ করতে বাধ্য হয়। সকলেই সঠিকভাবে কাজ করতে পারে।

জবাবে আমিন উদ্দিন বলেন, সাংবাদিক যদি ভুল রিপোর্ট করে থাকে তবে তো তার বিরুদ্ধে মানহানীর মামলা করার সুযোগ আছে। আরো আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে। তাই বলে মধ্যরাতে দরজা ভেঙে তার বিরুদ্ধে অভিযান? তিনি বলেন, এমন যদি হতো যে ওই এলাকার সব বাড়িতেই অভিযান চালানো হয়েছে, আর শুধুমাত্র সাংবাদিকের বাড়িতে কথিত মদ ও গাঁজা পাওয়া গেছে তাহলে হয়তো বিশ্বাসযোগ্য ছিল। অথবা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে যদি অভিযান হতো তাহলেও সেটা বিশ্বাসযোগ্য ছিল। মামলার কোথাও এটা বলা নেই। কিন্তু শুধুমাত্র সাংবাদিকের বাড়িতে অভিযান। এ থেকে এটা স্পষ্ট যে, অসৎ উদ্দেশে এই অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে।

আদালত বলেন, যেহেতু এরইমধ্যে আরিফুল জামিনে মুক্তি পেয়েছে। তাই আমরা মামলাটি এই পর্যায়ে রাখছি। সব আসুক। এরপর ভালভাবে শুনবো। এ সময় আদালত রিট আবেদনকারীপক্ষকেও ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়ে আসতে পরামর্শ দেন।

আদালত বলেন, আরিফুলকে আবেদনকারী বানাতে পারেন। তাহলে আইনগত সুবিধা হবে আপনাদের। তাকে নিয়ে আসতে পারেন কিনা দেখুন। তার বক্তব্য শুনি। জবাবে এ এম আমিনউদ্দিন বলেন, এটা জনস্বার্থমূলক মামলা হিসেবেই শুনানি হোক। আর আরিফুলকে আনা যায় কিনা সেটা চেস্টা করা হবে। 

শুনানির এক পর্যায়ে আদালত কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের ভূয়সী প্রশংসা করেন।

আদালত বলেন, টিভিতে দেখলাম, প্রতিমন্ত্রী সাহেব ব্রিফিং করছেন। ওই ডিসির বিষয়ে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বলেননি যে মিটিং করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তার পদক্ষেপ ভালো লেগেছে। একারণে তাকে অভিনন্দন জানানো যায়।

রিগ্যানের বিরুদ্ধে তার বাড়িতে ‘আধা বোতল মদ ও দেড়শ গ্রাম গাঁজা’ পাওয়ার ঘটনায় ভ্রাম্যমাণ আদালত তাকে একবছর কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরো ১৫ দিন জরিমানা করে। এ ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা হয়। এ অবস্থায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. সুজাউদ্দৌলা ১৪ মার্চ সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগ্যানকে জামিন দেন। এরপরই রিগ্যান জামিনে মুক্তি পান। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সূত্র্র: কালের কন্ঠ অনলাইন