আদিবাসী যুবতীদের আমরণ জীবনযুদ্ধ

রুমিলা হেমরন। গেল বছর এসএসসি পাশ। এখন এইচএসসিতে। বিয়েও হয়েছে তার। স্বামীর অভাবের সংসার। তাই পড়ালেখার পাশাপাশি সে অন্যের জমিতে দিনমজুরী করেন। সাথে তার স্কুল পড়ুয়া ননদ যশিপিনা মার্ডিও।

পীরগঞ্জের বড়দরগাহ ইউনিয়নের দিগদুয়ারী গ্রামের ভেক্টর হেমরনের মেয়ে রুমিলা। পাশ্ববর্তী দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার কশিবাড়ী গ্রামের রিপন মার্ডির সাথে গত বছর তার বিয়ে হয়েছে। শ্বশুরবাড়ীতে গিয়ে মওসুমী শ্রমিক হিসেবে মাঠে-ঘাটে কাজ করছেন। কাজ থাকলে মজুরী চলে, রুমিলাদের জীবন তখন ভাল চলে। কিন্তু পারিশ্রমিক কম। দিনভর শ্রম, মজুরীও কম এভাবেই কাটছে আদিবাসী যুবতীদের জীবন।

গত ৮ ফেব্রুয়ারী দুপুর বেলা। দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের কশিবাড়ী গ্রামের পথ দিয়ে চলার সময় জমিতে দেখা মেলে কয়েকজন আদিবাসী তরুনী ও মহিলার। তারা কাঁদামাটিতে হাঁটুতে ভর দিয়ে উপুড় হয়ে ইরি-বোরোর চারা রোপন করছে। এ রকম আরও বেশ কয়েকটি জমিতে নারী শ্রমিকরা কাজে ব্যস্ত। কেউ ধানের চারা গাছ নিয়ে মুটিতে পুঁতে দিচ্ছে। আবার কেউ জমির আইলের উপর বসে পাতার বিড়ি লাগিয়ে ধুমপান করছেন। জমির সরু আইল ধরে শরীরের ভারসাম্য ঠিক রেখে কথা বলতেই কষ্ট করে তাদের কাছে পৌঁছি। নইলে ‘পা’ ফসকে গেলেই কাঁদায় পড়তে হতো।

রুমিলার সাথে কথা বলে জানা যায়, রংপুরের পীরগঞ্জে তার বাবার বাড়ী। গত বছর এসএসসি পাশের পরই বিয়ে হয় তার। এখন সে ঘোড়াঘাটের রানীগঞ্জ মহিলা ডিগ্রি কলেজে একাদশ শ্রেনীতে পড়ছে। স্বামী রিপন মার্ডি ওষুধের দোকানের কর্মচারী। সাথে তার ননদ যশিপিনা মার্ডি, প্রতিবেশী পূর্নিমা। তারা দু’জনই রানীগঞ্জ সরকারী দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের ১০ম শ্রেনীর ছাত্রী। আরও এক গৃহবধু লক্ষী রানী। ৪ জনই চারা রোপন করছে।

লক্ষীর স্বামী ফিলিপস। সেও শ্রমিক। লক্ষীর ১০ বছরের সংসার জীবন, সন্তান নেই। তারপরও অভাব মেটাতে মাঠে কাজ করছে সে। লক্ষী জানায়, একজন পুরুষের সমান কাজ করলেও মহিলা হওয়ায় দিনে ৩’শ টাকা মজুরী, একবেলা খাবার দেয়। অপরদিকে একজন পুরুষ শ্রমিক ৫’শ টাকা মজুরী আর সকাল ও দুপুরে খাওয়ানো হয়। ১০ম শ্রেনীর ছাত্রী পুর্নিমা বলে, আমরা কোনভাবেই পুরুষের চেয়ে কম কাজ করি না। অথচ মজুরী বৈষম্যের শিকার হচ্ছি। শুধু পড়ালেখার খরচ মেটাতেই কাজ করছি।

স্কুলে উপবৃত্তি না পাওয়ায় দুঃখ করে বড় নিঃশ্বাস ফেলে যশিপিনা মার্ডি বলে, উপবৃত্তি নিয়ে বাঙ্গালীদেরই টানাটানি। সেখানে আমাদের হিসাব আশা করা যায় কি? সে আরও বলে, আমার বাবা পাগল মার্ডি। খাবার খরচ দিতে তার কষ্ট হয়। তাই কাজ করে লেখাপড়াসহ আনুষাঙ্গিক খরচ চালিয়ে আসছি।

পাশের জমিতে আরও কয়েক আদিবাসী নারী শ্রমিকের কাজ করছে। এ সময় তারাও চলে আসে। পারিশ্রমিকের ব্যাপারে তারাও তাদের অসন্তুষ্টির কথা জানিয়ে বলেন, হামরা সারাদিন কাজ করে মাত্র ৩’শ টাকা পাই। এটা অনেক কম।

পীরগঞ্জের ইউএনও টিএমএ মমিনের ভুতপূর্ব কর্মস্থল ঘোড়াঘাট উপজেলা। তিনি সেখানকার ১০ হাজার আদিবাসী পরিবারের সদস্যদের জীবন মানোন্নয়নে সরকারের কাছে তাঁত শিল্প প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাবনা দেন। ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ব্যক্তিদের জন্য বেশকিছু প্রকল্প গ্রহন করা হয়। এরমধ্যে তাঁত শিল্প প্রশিক্ষণও একটি।

পরে ঘোড়াঘাটে ‘ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীদের জন্য বঙ্গবন্ধু তাঁত শিল্প প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’ স্থাপন করে কেন্দ্রটির মাধ্যমে আদিবাসী নারী-পুরুষরা প্রশিক্ষণ নিয়ে শাড়ী, লুঙ্গি, গামছাসহ বিভিন্ন ধরনের কাপড়-চোপড় বাজারজাত করছে।

ইউএনও টিএমএ মমিন বলেন, ঘোড়াঘাটের আদিবাসীরা কর্মঠ হওয়া সত্ত্বেও কাজ না থাকায় অলস সময় কাটাতো। তাই তাদের জন্য ওই প্রকল্প গ্রহন করেছিলাম। সেটি এখন প্রশংসিত এবং কয়েকশ আদিবাসী নারী-পুরুষ কাজ করছে সেখানে।

জেএম/রাতদিন