ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ১৮তম ব্যাচের সাবেক শিক্ষার্থী জাকারিয়া বিন হক শুভ। রাজধানীর ভাড়া বাসা থেকে তার মরদেহ উদ্ধার হয় ২৪ সেপ্টেম্বর। এ ঘটনায় থানায় হত্যা মামলা হয়েছে। সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবিতে বিভিন্ন জায়গায় চলছে বিক্ষোভ, মানববন্ধন। শুভকে নিয়ে রাতদিননিউজের মতামত বিভাগের জন্য লিখেছেন তার স্কুলশিক্ষক সাবিরা বেগম ডলি:
আমি তার মা নই, নই বোন। খালা, ফুফু, চাচি, মামি কেউই না। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অদৃশ্য এক সম্পর্ক মাত্র। তবুও তার এই মৃত্যুটাকে মেনে নিতে পারছি না কিছুতেই।
সেই কবেকার কথা। তখন বালক শুভ পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী। ক্লাসে ঢুকলেই কী জানি একটা ভয়ে সিঁটকে যেত। ঠিক ভয় কী না তাও বুঝতাম না। তবে ননদের ছেলে তুরাগসহ কয়েকজন বেশ সজাগ থাকতো আমার ক্লাসে। দুষ্টামি থেকে শুরু করে ক্লাস ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব সবকিছুতে তারাই ছিল অগ্রগামী।
তারা বড় হলো। হাইস্কুল পেরিয়ে কলেজে চলে গেলো। পার্থিব ব্যবধান তৈরী হলো ঠিকই, তবে আত্মিক সম্পর্কটা তেমনই ছিলো। যখন সে বাড়িতে আসতো তখন হয়তো আমার স্কুলে যাওয়া-আসায় মাঝেমধ্যে দেখা হতো।
এরপর সেই ছাত্র হলো আমার বন্ধু। মানে ফেসবুক বন্ধু। আবার ফিরে পেলাম আমার প্রিয় প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীদের। তারমধ্যে শুভ অন্যতম। যে কী না বলতো, “ম্যাডাম আপনার মতো শিক্ষকের সান্নিধ্যে যখন ছিলাম তখন অনেক ভালো ছিলাম। আপনার রাগ, ভালোবাসা আর স্নেহ মিলে যা পেয়েছি এখন আর সেটা পাওয়াই মুশকিল। এখন ছোটরা সেটা পায় না। মারও নেই তাই ক্লাশে ভয়ও নেই। “
সত্যিই তো, ওদের কতো মেরেছি, কতো বকেছি, তবুও ওরা এত ভালোবাসতো আমাকে, পাগলের মতো।
চোখের সামনে সেই ছেলেটার করুণ মৃত্যু সইতে পারা যে কতো কষ্টের তা কাকে বলবো? শুধু নিজের ছেলে দুটোকে বুকে আঁকড়ে ধরে কেঁদেছি। আহা! আজ ওর মা কী করছেন? কীভাবে বেঁচে থাকবেন? আল্লাহকে বলেছি, তুমি ওর মাকে ধৈর্য্যধারণ করার ক্ষমতা দাও, নাহয় জ্ঞানহীন একটা দেহ বানিয়ে দাও।
দুর্ঘটনার দিন রাতভর তার মৃতদেহের ছবি, ভিডিও দেখে লাফিয়ে উঠে ছেলের কাছে যাই। বলি, বাবা শুভ আত্মহত্যা করেনি, দেখ ছবিগুলো। ছেলেও ডুকরে কাঁদে। শুভর প্রোফাইলে ঢুকে খুঁজি, সে কিছু লিখেছে নাকি?
কেন বাবা? এত যন্ত্রণা নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে বাঁচতে কে বলেছে তোকে? বউ এর চেয়ে আপন তো কতোজন ছিল। মা, ভাই, বোন, বন্ধু, ছোটভাইরা, বড়রা। তাদেরকে একটু বলে গেলেই তো পারতিস। কিছু না বলেই চলে গেলি তো! নিঝুম নিরালায় এক মাটির বিছানায় চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে গেলি। তুই কি ইচ্ছে করেই ঘুমালি? নাকি কেউ তোকে পাঠিয়ে দিলো ঘুমের দেশে?
শত কষ্টের সমাপ্তি ঘটিয়ে শুভ চলে গেছে। স্মৃতিস্বরূপ রেখে গেছে তার ভালোবাসার গল্পগুলো। আর হাজার হাজার জলভরা চোখ। চোখের নোনা জলে লেখা হয়ে গেল এক কাহিনী, “শুভর অস্বাভাবিক করুণ মৃত্যু।”
আজ ইথারে ভাসছে একটি কথাই, শুভর মৃত্যুর জন্য দায়ী কে? কার হাত এতটাই নিষ্ঠুর?
জানি না এর জবাব কখনো পাবো কী না।
ভালো থাকিস পরপারে। আমাদের দোয়া তোর জন্য সবসময়।
লেখক: সাবিরা বেগম ডলি, প্রধান শিক্ষক, মধ্য গোপালরায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কালীগঞ্জ, লালমনিরহাট