যুদ্ধকালীন বীরত্বের সম্মাননা দিয়ে কী বার্তা দিল ভারত?

হিমালয় পর্বতে চীন ভারত সীমান্তে গালওয়ান উপত্যকায় ভারতীয় ও চীনা সেনাবাহিনীর সদস্যের মধ্যে গত বছরের জুনের হাতাহাতির ঘটনায় নিহত সেনাদের যুদ্ধে সাহসিকতা প্রদর্শনের জন্য দেওয়া সম্মাননায় ভূষিত করেছে ভারত সরকার। এরপর এখন প্রশ্ন উঠছে, লাদাখে চীনের সঙ্গে চলমান বিরোধকে কি ভারত তাহলে যুদ্ধের মতো করে দেখছে?

২৬ জানুয়ারি ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের আগের সন্ধ্যায় বীরত্বের এই পুরস্কারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসে ভারত সরকারের তরফ থেকে। একইসঙ্গে ঘটনার প্রায় ৭ মাস পর এসে ভারত সরকার অবশেষে আনুষ্ঠানিকভাবে জানালো যে ওই রাতে আসলে কী ঘটেছিল। এর আগ পর্যন্ত ভারত-চীনের সেনাদের ওই হাতাহাতির ঘটনা নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো তথ্য ছিল না বললেই চলে।

২০২০ সালের ১৫ জুনের ওই ঘটনায় ২০ ভারতীয় সেনা নিহত হয়েছিলেন। তবে ওই সংঘর্ষে চীনের কতজন সেনা নিহত হয়েছিল সে বিষয়ে পরিষ্কার করে এখনও কিছু জানা যায়নি। এ ঘটনার পর থেকে দুই দেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে।

সেদিন যে ২০ জন ভারতীয় সেনা নিহত হয়েছিলেন তাদের একজন কর্নেল বি. সন্তোষ বাবু; যিনি ১৬ বিহার রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন। সন্তোষ বাবুকে মরণোত্তর মহাবীর চক্র পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে। এটি ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সামরিক পুরস্কার।

এ পুরস্কারের সঙ্গে দেওয়া উদ্ধৃতিতে তুলে ধরা হয়েছে সেই রাতের ঘটনা। এতে বলা হয়েছে, “কর্নেল সন্তোষ বাবু অপারেশন স্নো লেওপার্ড চলাকালীন গালওয়ান উপত্যকায় (পূর্ব লাদাখ) মোতায়েন ছিলেন। তাকে শত্রুর মোকাবিলার জন্য একটি পোস্ট স্থাপন করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। সুসংগঠিত পরিকল্পনা মাফিক কর্নেল সাফল্যের সাথে এই কাজটি সম্পাদন করেছিলেন। এই পদে অধিষ্ঠিত থাকাকালীন তিনি বিপক্ষের কঠোর প্রতিরোধের মুখোমুখি হন। তারা মারাত্মক এবং ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করে কর্নেলকে আক্রমণ করেছিল। তার ওপর উঁচু জায়গা থেকে পাথর ছোঁড়া হয়।”

উদ্ধৃতিতে আরও বলা হয়েছে, “কর্নেল সন্তোষ বাবু বীরত্বের সঙ্গে দেশকে রক্ষার জন্য কাজ করেন। গুরুতর আহত হওয়া সত্ত্বেও তিনি নিজের অবস্থানে অনড় ছিলেন। নেতিবাচক পরিস্থিতি সত্ত্বেও তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি তার শেষ নিশ্বাস অবধি শত্রুর আক্রমণকে প্রতিহত করেছিলেন এবং তার জওয়ানদের দেশের মাটিকে রক্ষা করতে অনুপ্রেরণা ও উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।”

সন্তোষ বাবুর সাথে বীরত্বের জন্য আরও যাদের সম্মানিত করা হয়েছে
• মহাবীর চক্র
কর্নেল বিকুমাল্লা সন্তোষ বাবু, ১৬ বিহার রেজিমেন্ট (মরণোত্তর)

• বীর চক্র
নায়েব সুবেদার নুদুরাম সোরেন, ১৬ বিহার রেজিমেন্ট (মরণোত্তর)
হাবিলদার কে পালানি, ৮১ এফডি রেজিমেন্ট (মরণোত্তর)
হাবিলদার তেজিন্দর সিংহ, ২ মেডিক্যাল রেজিমেন্ট
দীপক সিংহ, এএমসি, ১৬ বিহার রেজিমেন্ট (মরণোত্তর)
সিপাই গুর্তেজ সিংহ, ৩ পঞ্জাব রেজিমেন্ট (মরণোত্তর)

• কীর্তি চক্র
সুবেদার সঞ্জীব কুমার, ৪ প্যারা (এসএফ) (মরণোত্তর)

• শৌর্য চক্র
মেজর অনুজ সুদ, গার্ডস, ২১ রাষ্ট্রীয় রাইফেলস (মরণোত্তর)
রাইফেলম্যান প্রণব জ্যোতি দাস, ৬ অসম রাইফেলস
প্যারাট্রুপার সোনম শেরিং তামাং, ৪ প্যারা (এসএফ)

যুদ্ধকালীন সাহসিকতা প্রদর্শনের জন্য ভারত তার সেনা সদস্যদের হাতে যেসব সম্মান তুলে দেয়, সেগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলো পরমবীর চক্র। এরপর আছে মহাবীর চক্র ও বীর চক্র। শান্তিকালীন বীরত্বের সর্বোচ্চ পুরস্কার অশোক চক্র, কীর্তি চক্র এবং শৌর্য চক্র।

চীনা সেনাদের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় ভারত সরকারের দেওয়া এই ‘চক্র সম্মাননার’ বিষয়টিকে অন্য মাত্রায় দেখার একটা সুযোগ রয়েছে। আর প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা তেমনভাবেই দেখছেন এ ঘটনাকে। কারণ, মহাবীর চক্রটি যুদ্ধকালীন সময়ে দেওয়া বীরত্বের পুরস্কার বা সম্মাননার অন্তর্ভুক্ত। এরআগে ১৯৯৯ সালে এই পুরস্কার একবার দেওয়া হয়েছিল যখন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কারগিল যুদ্ধ চলছিল

এই সম্মাননার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসার আগে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক নিতীন গোখলে টুইটারে লিখেছিলেন, গত বছরের জুনে ১৯ ভারতীয় সেনার সঙ্গে প্রাণ হারানো সন্তোষ বাবুকে যদি মহাবীর চক্র পুরস্কার দেওয়া হয় তাহলে এটা স্পষ্ট যে ভারত লাদাখে চীনের সঙ্গে চলমান বিরোধকে যুদ্ধের মতো করেই দেখছে। এর আগে ১৯৯৯ সালে কারগিল যুদ্ধের সময় বীরত্ব দেখানোর জন্য এ সম্মাস দেওয়া হয়েছিল।

এটি ভারতের দ্বিদীয় সর্বোচ্চ সর্বোচ্চ সামরিক পুরস্কার।

বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বিরোধপূর্ণ ভূখণ্ড রয়েছে ভারত ও চীনের মধ্যে। উভয় দেশই দাবি করে যে, অন্য দেশের ভেতরে তাদের এলাকা রয়েছে।


চীন ও ভারতের সীমান্তে উত্তর সিকিমের নাকুলাতে দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে দিনদশেক আগে নতুন করে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে বলে জানা যাচ্ছে। সংঘর্ষে দুপক্ষের সেনারাই আহত হয়েছে বলেও খবর রয়েছে। ভারতের পক্ষ থেকে এটিকে অবশ্য ‘তুচ্ছ ঘটনা’ বলে বর্ণনা করে সংঘর্ষকে খাটো করে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে। চীনের পক্ষ থেকে নাকুলার ঘটনা নিয়ে এখনও কোনো বিবৃতি আসেনি।

এ ঘটনার বিষয়ে ভারতীয় সেনা এক সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘নাকুলার ঘটনায় প্রতিষ্ঠিত প্রোটোকল অনুসরণ করে স্থানীয় কমান্ডাররাই বিষয়টির মিটমাট করে নিয়েছেন।’ তবে গত সাত মাসের মধ্যে এই প্রথম ভারতীয় বাহিনীর পক্ষ থেকে চীন সীমান্তে নতুন করে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে বলে স্বীকার করে নেওয়া হলো।

সূত্র : বিবিসি ও বিভিন্ন ভারতীয় সংবাদমাধ্যম।

এনএ/রাতদিন

মতামত দিন