ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ১৮তম ব্যাচের সাবেক শিক্ষার্থী জাকারিয়া বিন হক শুভ। রাজধানীর ভাড়া বাসা থেকে তার মরদেহ উদ্ধার হয় ২৪ সেপ্টেম্বর। এ ঘটনায় থানায় হত্যা মামলা হয়েছে। সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবিতে বিভিন্ন জায়গায় চলছে বিক্ষোভ, মানববন্ধন। শুভকে নিয়ে রাতদিননিউজের মতামত বিভাগের জন্য ঢাকা থেকে লিখেছেন তার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু ও ব্যাংক কর্মকর্তা রিয়াদ আল সাহাফ:
শুভ আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। আমি আজ ওর সাথে আমার স্মৃতি বা আবেগ তুলে ধরব না। শুধু তার অপমৃত্যুর নিরপেক্ষভাবে যা দেখেছি, যা সবার জানা উচিৎ, যেসব অসামঞ্জস্যতা আমার চোখে পড়েছে, তা-ই তুলে ধরছি।
‘শুভ সুইসাইড করেছে’ জারিফের ফোন পেয়ে থমকে গেলাম। এরকম ফোন কখনোই ভাবিনি। কথাটি শুনেই ফোন কেটে দিলাম। দিপ, উদিতকে ফোন দিলাম, তারাও নিউজটি পেয়েছে। এটা হতে পারে না। শুভ সুইসাইড করতে পারে না। নিশ্চয়ই আমাদের সাথে অনেকদিন দেখা হয় না বলে, এভাবে আমাদের ডেকেছে। বাসায় গেলেই সারপ্রাইজ পাবো। আমি এসব সারপ্রাইজের ধার ধারি না। আমার বন্ধুর সাথে কোনোদিন দেখা না হলেও চলবে, কিন্তু এমনভাবে মজা করবে কেন? ভাবছি থাপড়ে একেকটার দাঁত ফেলে দিবো।
শুভর স্ত্রী শেহনীলা নাজ শেনকে ফোন কোরলাম। শেনের সাথে দীর্ঘ কয়েক বছরের বন্ধুত্ব ও ৫ বছরের প্রেমের সম্পর্কের পর মাত্র ৯ মাস আগে ওরা বিয়ে করেছে। ফোন রিসিভ হতেই জিজ্ঞেস করলাম, ‘শেন, শুভ কোথায়?’ একটা মেয়েলী কন্ঠ বলল, ‘ভাইয়া, আমি শেনের ছোটবোন। শুভ ভাইয়া সুইসাইড করেছে। আপনারা তাড়াতাড়ি বাসায় আসেন।’
লিসাকে বলা মাত্রই সে কান্নাকাটি শুরু করল। আমিও কাঁদছি আর হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের ক্লোজ ফ্রেন্ডদের ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে কল দিলাম। জিসান, নিম্মি সবাই কান্নাকাটি করছে। আমি আর লিসা লালমনিরহাটে শুভর গ্রামের বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে ব্যাগ গুছিয়েই বের হয়ে গেলাম। রাস্তায় সৌরভ আমাদের সিএনজিতে উঠল।
সৌরভও বলছে, আরে শুভ এইসব করবে কেন? নিশ্চয়ই আমাদের সাথে অন্যরা মজা করছে। আমিও তাই ভাবছি। শুভতো অনেক ম্যাচিউর্ড। আমরা তাকে কী বোঝাব, সেই তো আমাদের বোঝায়। সেবার আমাদের এক ক্লাসমেট সুইসাইড অ্যাটেম্পট নেয়ার পর শুভই তো আমাকে বলল, ‘ওই ছেলেটা বিরাট ডিপ্রেশনে আছে। ও তোকে খুব পছন্দ করে। তুই সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলিস। তুই ওকে বোঝাতে পারবি। ওকে ডেকে একদিন কাউন্সেলিং দে।’
এসব ভাবতে ভাবতেই শুভর বাসায় পৌঁছে গেলাম। আমাদের আগেই দিপ, উদিত, জারিফ, মাসনুন ভাই পৌছে গেছেন। নিচে পরিচিত-অপরিচিত মানুষে ভীড় দেখে বুঝতে আর বাকি রইল না। আমাদের আগেই পুলিশকে জানানো হয়েছিল।
দোতলার বাসায় যেতেই চোখে পড়ল বেডরুমের মেঝেতে শুভর নিথর দেহ পড়ে আছে। মাথার উপর ফ্যানটা ঘুরছে। শুভর পরণে শুধু জিন্সের প্যান্ট। পাশেই শুভর মামী বসে কান্নাকাটি করছেন। শেনসহ তার পরিবারের লোকজন অন্য রুমে ছিল। জানতে পারলাম, শুভর সিগারেট খাওয়াকে কেন্দ্র করে দুজনের মধ্যে ঝগড়া হয়, এবং অন্য রুমে শেন নামাজে থাকাকালীন শুভ বেডরুমে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ফ্যানের সাথে ঝুলে পড়ে। নামাজ শেষে শেন এসে ঝুলন্ত লাশ দেখে ছুড়ি দিয়ে ওড়না কেটে ফেলে, লাশ নামায়।
অ্যাম্বুলেন্সে আমরা শুভর মরদেহ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গে নিয়ে যাই। পরদিন সকালে ময়নাতদন্ত হয় এবং বাবর রোডের আল-মারকাজুল ইসলাম মসজিদে গোসল করানোর পর, সেখানেই প্রথম জানাজার নামাজ হয়। এরপর শুভর বোন, দুলাভাই, আমরা, ভার্সিটির কয়েকজন সিনিয়র ভাই, শুভর সহকর্মীরা মিলে ফ্রিজিং অ্যাম্বুলেন্স এবং দুইটা হায়েস গাড়ি নিয়ে আমরা লালমনিরহাটের উদ্দেশ্যে রওনা হই।
এখানে কিছু ব্যাপারে মারাত্মক অসামঞ্জস্যতা আছে। ব্যাপারগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
১. শুভ যদি আত্মহত্যাই করবে তাহলে দরজা খোলা রাখবে কেন? কেউ মরতে চাইলে তো আর দরজা খোলা রেখে অন্যদের রুমে ঢোকার সুযোগ রেখে গলায় দড়ি দিবে না।
২. তাদের ভাষ্যমতে শেন একাই ছুড়ি দিয়ে ওড়না কেটে শুভর লাশ নামায়। আপনারা যারা শুভকে চেনেন, আপনারা দেখেছেন শুভর ওজন ৮৫–৯০ কেজি হবে। এত ভারী একজন মানুষকে নিশ্চয়ই কোলে তুলে একা নামানো সম্ভব না। ওড়না কেটে দিলে লাশটা ধুপ করে নিচের বিশাল খাটে পড়ার কথা। তাহলে লাশটা ফ্লোরে পড়ল কীভাবে?
৩. যদি ধরেও নেই পিছলে ফ্লোরে পড়েছে, তাহলে এত ভারী একটা দেহ টাইলসের ফ্লোরে পড়ে তো মাথা ফেটে যাবে বা হাত-পা জখম হবার কথা। তাহলে বডিটা ফ্রেশ ছিল কেন?
৪. লাশ নামিয়ে আমাদের এক বন্ধুকে জানানোর পর সে বলল, হাসপাতালে নিয়ে যাও। হাসপাতালে না নিয়ে বাসায় কেনো বসে থাকা হলো? শুভকে কি বাঁচানোর পরিবর্তে মৃত্যু জন্য আরও সময় দেয়া হলো?
৫. একজন স্ত্রী যখন দেখবে, তার স্বামী ফ্যানের সাথে ঝুলে আছে, সে তো সেখানেই চিৎকার করে পড়ে যাবার কথা। অন্ততপক্ষে পাশের ফ্ল্যাটের লোকজন তো ঘটনাটা আগে টের পাবে? সে একা একা লাশ নিয়ে মা-বোনের জন্য বসে ছিল কেন? এত ঠান্ডা মাথায় এইসব কাজ করা কীভাবে সম্ভব? তাহলে কি ব্যাপারটা পূর্বপরিকল্পিত?
৬. লাশ বাসা থেকে হাসপাতালের মর্গ, আল-মারকাজুল ইসলাম মসজিদে গোসল করানো, জানাজা সব মিলিয়ে প্রায় ১৭ ঘন্টা মোহাম্মদপুর এলাকাতেই ছিল। শেনের পক্ষের একজনও হাসপাতাল বা জানাজায় আসলো না কেনো?
৭. লাশের গলার উপরের দিকে শ্বাসনালীর দুই পাশে দুইটা স্পষ্ট দাগ ছিল। এটা ফাঁসির দাগ নাকি গলা টিপে ধরার দাগ, সেই প্রশ্নেরও উত্তর জানা নেই।
উপরের কোনো প্রশ্নেরই উত্তর পাইনি। আশা করছি ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পাওয়া গেলে আরও অনেক রহস্যের সমাধান হবে। এটা হত্যা নাকি আত্মহত্যা তা পরিষ্কার হবে। শুভকে হত্যা বা আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়ার বিচার নিশ্চিত করা যাবে।
লেখক: রিয়াদ আল সাহাফ, ব্যাংক কর্মকর্তা, ঢাকা