দুঃস্বপ্নেরও শেষ আছে! অন্ধকার শেষে এক সময় আলোর দেখা মিলবেই। মিলেছেও! ভারতের সঙ্গে ম্যাচ মানেই ছিল তীরে এসে তরী ডোবার গল্প! গত কয়েক বছর ধরেই শেষ ওভারের রোমাঞ্চে আক্ষেপে পুড়তে পুড়তে মাঠ ছেড়েছে বাংলাদেশ দল। কিন্তু এবার নির্ভার ক্রিকেটের জয়গান। বাংলাদেশ ক্রিকেটের দিল্লি জয়!
যখন কিছু হারানোর নেই, যখন দলের দুই সেরা তারকা সাকিব আল হাসান ও তামিম ইকবাল মাঠের বাইরে, তখনই রূপকথার জন্ম দিল বাংলাদেশ। দিল্লির অরুণ জেটলি স্টেডিয়ামে লেখা হলো নতুন এক ইতিহাস!
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ভারতের বিপক্ষে প্রথম জয়ের দেখা পেল বাংলাদেশ। সিরিজের প্রথম ম্যাচে টাইগাররা জিতল ৭ উইকেটে! স্বস্তি এটাই আরেকটি দুঃখগাথা আর লিখতে হলো না! অরুণ জেটলি স্টেডিয়ামে যেন শ্বশানের নীরবতা! ৩০ হাজার দর্শকের মাঠে কান পাতলে যেন পিন পতনের শব্দটাও শোনা যাবে!
ইতিহাসের একহাজারতম টি-টোয়েন্টিতে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ভারত ২০ ওভারে ৬ উইকেট হারিয়ে তুলে ১৪৮ রান। জবাবে নেমে বায়ুদূষণ আর ভারতের পেস-স্পিন উড়িয়ে ১৯.৩ ওভারে ৩ উইকেট হারিয়ে, স্বপ্নের এক জয়ের দেখা পেয়ে যায় লাল-সবুজের বাংলাদেশ।
আর এমন জয়ের নায়ক আসলে আলাদা করে কাকেই বা বলবেন? শুরুতে বল হাতে বোলাররা কম রানে আটকে রাখলেন ভারতকে। আমিনুল ইসলাম বিপ্লব, শফিউল ইসলামদের দাপটের পর ব্যাট হাতে স্লো উইকেটে এতোটা পরিণত ব্যাটিং! সৌম্য সরকারের ব্যাটে ৩৯, অভিষিক্ত মোহাম্মদ নাঈম শেখ ২৬। তবে কাজের কাজটা করলেন মুশফিকুর রহিম। তার অপরাজিত ৬০ রানেই হাসল বাংলাদেশ!
অথচ লিটন দাস বিদায় নিয়েছিলেন শুরুতেই! প্রথম ওভারে দিপক চাহারের বল সুইং করে বেরিয়ে যাওয়ার মুখে দ্বিধা নিয়ে খেলতে নেমেই ভুল করলেন। ক্যাচ তুলে দিয়ে তামিম ইকবালের জায়গায় খেলতে নামা এই ওপেনার ফেরেন ৪ বলে ৭ রানে।
তারপর শুরুর ধাক্কা সামলে উঠে লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা। সৌম্য সরকার-নাঈম শেখ পথ দেখাতে থাকেন দলকে। অভিষেকে দারুণ কিছু শট খেলে ফেরেন মোহাম্মদ নাঈম শেখ। যুজবেন্দ্র চাহালের বলে আকাশে ভাসালেন ক্যাচ। প্রথম আন্তর্জাতিক ইনিংসে নাঈম তুললেন ২৮ বলে ২৬ রান।
তারপর স্লো উইকেটে পরিস্থিতি বুঝে লড়ে গেছে বাংলাদেশ। সৌম্য সরকারের সঙ্গে মুশফিকুর রহিমের জুটি। দু’জন যোগ করেন ৬০ রান। এরপর স্লো উইকেটে মানিয়ে নিয়ে বাকীটা পথ পাড়ি দেন মুশফিক-মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। এই দুজনের ব্যাটে অরুণ জেটলি স্টেডিয়াম থেকে হাসিমুখ নিয়েই ফিরছে বাংলাদেশ।
এর আগে ডরহীন ক্রিকেট খেলেন বোলাররা! ভারতের শক্তিশালী ব্যাটিং লাইন আপের বিপক্ষে চোখে চোখ রেখেই স্পিন-পেস চলল। ভারতের ইনিংসে স্তব্ধতাই থাকল বেশি! কারণ বাংলাদেশের বোলারদেরই যে ছিল দাপট। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শাসন করলেন শফিউল ইসলাম, আমিনুল ইসলাম বিপ্লব আর আফিফ হোসেনরা।
ঝড়ের ইঙ্গিত দিয়ে শুরুটা হয়েছিল ভারতের। টস হেরে ব্যাট করতে নেমে ইনিংসের প্রথম বাউন্ডারি। শফিউল ইসলামকে পাত্তাই দিচ্ছিলেন না রোহিত শর্মা। কিন্তু আরেকটি বাউন্ডারি হাঁকাতেই ভারত অধিনায়ককে আটকে ফেলেন অভিজ্ঞ এই পেসার! ম্যাচের ষষ্ঠ বলেই ধরা দেয় সাফল্য। ইনসুইং করা বল সামাল দিতে পারেননি রোহিত। আম্পায়ার সাড়া দিলেও রিভিউ নেন এই ওপেনার। যদিও তাতে শেষ রক্ষা হয়নি।
অথচ দিনটা তারই হতে পারতো। মহেন্দ্র সিং ধোনিকে টপকে এদিন হয়েছিলেন ভারতের হয়ে সবচেয়ে বেশি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ (৯৯) খেলা ক্রিকেটার। এমন কী প্রথম ওভারে দুই বাউন্ডারিতে দেশের হয়ে ২০ ওভারের ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি রানেরও মালিক বনে গিয়েছিলেন রোহিত। বিরাট কোহলিকে টপকালেও ম্যাচটা তার হলো না।
ভারতীয় ইনিংসে পরের আঘাতটা হানেন আমিনুল ইসলাম। পাওয়ার প্লে শেষে বোলিংয়ে এসেই বাজিমাত এই লেগ স্পিনারের। ইনজুরি কাটিয়ে ফিরে উইকেট তুলে নেন প্রথম ওভারেই। সাজঘরের পথ দেখিয়ে দেন লোকেশ রাহুলকে। তার ডেলিভারিটি অফ স্ট্যাম্পের বাইরে দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই প্রলুব্ধ হন রাহুল। ব্যস, ব্যাটে-বলে ঠিকঠাক সংযোগ হলো না। মাহমুদউল্লাহর হাতে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন রাহুল (১৫)।
এরপর শ্রেয়াস আইয়ারকেও সাজঘরের পথ দেখিয়ে দেন তরুণ লেগি আমিনুল। শ্রেয়াসকেও (২২) ফাঁদে ফেলেন এই টাইগার বোলার। তার তুলে দেওয়া বল হাতে জমাতে ভুল করেননি অভিষেক ম্যাচ খেলতে নামা নাঈম শেখ।
এরপর বেশ লড়ে যাচ্ছিলেন শিখর ধাওয়ান। অবশ্য দিল্লির উইকেটে তেমন রানও ছিল না। বুঝে-শুনে এগিয়ে যাচ্ছিলেন এই অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান। কিন্তু ৪২ বলে ৪১ করে রান আউটে কাটা পড়েন তিনি। স্তব্ধ হয়ে যায় অরুণ জেটলি স্টেডিয়ামের পূর্ণ গ্যালারি!
শেষ ওভারে ১৬ রান নিয়ে স্কোরটাকে চ্যালেঞ্জিং করেছে ভারত। বাংলাদেশের হয়ে দুটি করে উইকেট নিয়েছেন শফিউল ও আমিনুল। একটি উইকেট আফিফের।
তবে ভারতের চ্যালেঞ্জটাকে টপকে যেতে বুদ্ধি দিয়েই লড়তে হয়েছে টাইগার ব্যাটসম্যানদের। গত কয়েক বছরেই তীরে এসে তরী ডুবেছে বাংলাদেশের। ২০১৬ সালে এই ভারতেরই বিপক্ষে বেঙ্গালুরুতে ৩ বলে ২ রানের সমীকরণ মেলাতে পারেন নি মাহমুদউল্লা-মুশফিক। কিন্তু এবার ঠিকই পারলেন।
শেষ ২ ওভারে চাই ২২ রান। তখনই খলিল আহমেদকে টানা চার মেরে দলকে নিয়ে যান স্মরণীয় জয়ের দ্বারপ্রান্তে। তারপর মাহমুদউল্লাহ ছক্কা হাঁকিয়ে দলকে উৎসবে ভাসান, গোটা বাংলাদেশ উজ্জীবিত হয় স্মরণীয় এক জয়ে।
সংক্ষিপ্ত স্কোর-
ভারত: ২০ ওভারে ১৪৮/৬ (ধাওয়ান ৪১, রোহিত ৯, রাহুল ১৫, শ্রেয়াস ২২, পান্ত ২৭, দুবে ১, পান্ডিয়া ১৫, সুন্দর ১৪; শফিউল ২/৩৬, আমিনুল ২/২২ ও আফিফ ১/১১)।
বাংলাদেশ: ১৯.৩ ওভারে ১৫৪/৩ (লিটন ৭, নাঈম ২৬, সৌম্য ৩৯, মুশফিক ৬০, মাহমুদউল্লাহ ১৫; চাহার ১/২৪, খলিল ১/৩৭, চেহেল ১/২৪ )।
ফল: বাংলাদেশ ৭ উইকেটে জয়ী
এনএ /রাতদিন