নানা রকমের রাজনীতি ঘিরে রেখেছে পুরো পৃথিবীকে। ফ্যামিলি পলিটিক্স থেকে ভিলেজ পলিটিক্সের ছোবলে হরহামেশাই আমরা দংশিত হই। তদুপরি, অফিস পলিটিক্স, ক্লাব পলিটিক্স, পাড়া-মহল্লার পলিটিক্সের কথা কে না জানে!
জাতীয় থেকে আন্তর্জাতিক পলিটিক্স পর্যন্ত হাজার ফেরকা মিডিয়ার বদৌলতে নিত্য চোখের সামনে দেখতে পাওয়া যায়। আরো আছে বা ছিল, ক্রিকেট পলিটিক্স, পিংপিং পলিটিক্স (চীনের সঙ্গে রাজনীতির প্রতীকার্থে), কালচারাল পলিটিক্স ইত্যাদি নানা রঙের রাজনীতি।
এতো রকমের পলিটিক্স দেখে মালুম হয়, আড়াই হাজার বছর আগে কত সত্য কথাই না বলে গেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আদিগুরু, গ্রিক পণ্ডিত অ্যারিস্ট্রোটল। তিনি বলেছিলেন, ‘মানুষ রাজনৈতিক জীব’।
রাজনীতির এহেন প্রবল দাপট টের পাওয়া যাচ্ছে, বৈশ্বিক মহামারি করোনার আক্রমণের মধ্যেও। ভাইরাস ছড়াতে কে দায়ী, তা নিয়ে প্রথমে শুরু চীন-মার্কিন তর্ক। তারপর মাস্ক পরিধান, সামাজিক দূরত্ব, লকডাউন ইত্যাদি নিয়ে নেতারা একে অন্যের মতের বিরোধিতা শুরু করেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বারবার বললো, রাজনীতি বন্ধ করুন, ঐক্যবদ্ধ হোন, করোনার কবল থেকে বিশ্ববাসীকে বাঁচান।
কেউ শুনলেন, কেউ শুনলেন না বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ। বরং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে দু’চারটা কথা শুনিয়ে দিতে কসুর করলেন না কেউই। তদুপরি শুরু করলেন করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে রাজনীতি।
করোনাকালে ভ্যাকসিন পলিটিক্স শুরু হয় তখনই, যখন নানা দেশ তাদের আবিষ্কারকে প্রথম ও বিশ্বসেরার তকমা লাগাতে উদ্যত হয়। ট্রায়ালে প্রাপ্ত বাস্তবতার অনেক কিছুই গোপন করা হয়। রাজনীতির শক্তি কাজে লাগানে হয় বাজার ধরতে। কে কত বেশি দেশের কাছে ভ্যাকসিন বিক্রি করতে পারে, তা নিয়ে শুরু হয় গোপন পলিটিক্স।
মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোও শুরু করে পলিটিক্স। এইসব বহুজাতিক কোম্পানির প্রথম ও শেষ কথাই হলো মুনাফা। তাদের রাজনীতি সম্প্রসারিত হয় ভোক্তা ও ক্রেতার সংখ্যা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে।
ভ্যাকসিন পাওয়ার জন্য বৈশ্বিক প্রতিযোগিতাভিত্তিক পলিটিক্সও শুরু হয় একই সঙ্গে। ধনী দেশগুলো ভ্যাকসিন বাজারজাতকরণের বহু আগেই তাদের চাহিদা পূরণের জন্য আগাম অর্থায়ন করে রাখে। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই পৃথিবীর বড় বড় তিনটি ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান থেকে লাখ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন পাওয়ার আশায় ৩ বিলিয়ন ডলার আগাম লগ্নি করার ঘোষণা দিয়েছে।
একই সময়ে বিশ্বব্যাংক অপেক্ষাকৃত দরিদ্র দেশগুলোর বেশির ভাগ মানুষের কাছে করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন সেবা পৌঁছে দেয়ার জন্য ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি প্রস্তাবনা তৈরি করেছে। এই প্রস্তাবনাটি অক্টোবরের প্রথম দিকে সংস্থাটির সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরামে (বোর্ড অব এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টরস) অনুমোদনের জন্য দাখিল করা হবে।
কিন্তু এই সম্ভাব্য বৈশ্বিক তহবিল থেকে অর্থ পেতে হলেও আশ্রয় নিতে হবে পলিটিক্সের। প্রথমেই যেটা করতে হবে সেটা হলো, এই অর্থ পাওয়ার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করা। তার সঙ্গে থাকতে হবে করোনা-ভ্যাকসিন অর্থায়ন, ক্রয়, বিতরণসহ একটি সুনির্দিষ্ট অ্যাকশন প্ল্যান। সমগ্র জনগোষ্ঠীর কোনো কোনো অংশকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রথম ধাপে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হবে, কীভাবে কাঙ্ক্ষিত জনগোষ্ঠীর কাছে ভ্যাকসিন নিয়ে পৌঁছানো যাবে, ভ্যাকসিন ক্রয় এবং বিতরণে সর্বমোট কত টাকা খরচ হবে, জাতীয়ভাবে কত টাকা অর্থায়ন করা যাবে, বাড়তি অর্থের চাহিদা কত, বিশ্ব ব্যাংকের এই ১২ বিলিয়ন ডলার তহবিল থেকে কত টাকা নেয়ার প্রয়োজন আছে ইত্যাদি, ইত্যাদি।
তার মানে অতি সহজ। খাদ্য ও সাহায্যের মাধ্যমে যে নিয়ন্ত্রণ ও নির্ভরশীলতা বড় বড় দেশগুলো ক্ষুদ্র ও দুর্বল দেশের উপর কায়েম রেখেছিল এত বছর ধরে, সেটাই করা হবে করোনা ভ্যাকসিনের মাধ্যমে। ভ্যাকসিন পলিটিক্স আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে জন্ম দেবে নির্ভরতার আরেক রাজনীতি। অর্থাৎ, মানুষের জীবন-মরণের মতো অতি মানবিক ইস্যুও থাকতে পারবে না বৃহৎ রাষ্ট্র ও বহুজাতিক কোম্পানির ‘পলিটিকাল থাবা’র বাইরে!
সূত্র: বার্তা২৪.কম