মাথার চুল বিক্রি করে সন্তানদের খাবার দিলেন মা

মাথা ভর্তি চুল একসময় অনেক প্রিয় ছিল প্রেমা সেলভামের। কিন্তু সন্তানদের মুখের দিকে চেয়ে একদিন ভালোবাসার সেই চুল বিক্রি করতে বাধ্য হলেন তিনি। চুল বিক্রি করে সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিতে হয়েছে তাকে।

ঘটনাটি ভারতের নামিলনাড়ুর। তিন সন্তানের জননী প্রেমা ক্ষুধার্ত সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিতে মাত্র ১৫০ রুপিতে(১৭৮ টাকা) নিজের চুল বিক্রি করতে বাধ্য হন। সম্প্রতি বিবিসির কাছে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রেমা তার সেইসব দিনের অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছেন।

বিবিসি জানায়, স্বামীর মৃত্যুর আগে প্রেমা ও তার স্বামী স্থানীয় এক ইটভাটায় কাজ করতেন। দুজনের আয়ে সংসার ভালোই চলছিল। তবে বড় স্বপ্নে প্রেমার স্বামী নিজে ইটভাটা করার জন্য একদিন ব্যাংক থেকে বড় ঋণ নেন। কিন্তু ব্যবসায় সফলতা না আসায় এবং ঋণে জর্জরিত হয়ে গত বছর তিনি আত্মহত্যা করেন।

স্বামীর মৃত্যুর পর প্রচণ্ড চাপে পড়েন প্রেমা। তিন সন্তানসহ নিজের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা শুধু নয়, পাওনাদারদের অর্থ পরিশোধের চাপও এসে পড়ে তার ওপর।

 প্রেমা বিবিসিকে জানান, কাজে গেলে তিনি দৈনিক ২০০ রুপি অর্থ উপার্জন করতে পারতেন, যা তার পরিবার চালানোর জন্য যথেষ্ট। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়ায় তার আয়ও কমে যায়।

প্রেমা বলেন, ‘ ওই সময় আমি ভারি ইটের বোঝা টানতে পারতাম না। জ্বরের কারণে দিনের বেশিরভাগ সময় আমি বাড়িতে থাকতাম।’

একবার প্রেমা তিন মাস অসুস্থ ছিলেন। ঋণ বাড়ছিল, সেই সঙ্গে খাবারের পাত্রও শূন্য হচ্ছিল। প্রেমা জানান ওই সময় একদিন তার সাত বছরের ছেলে কালিয়াপ্পান স্কুল থেকে ফিরে তার কাছে খাবার চায়। খাবার না পেয়ে ক্ষুধায় কান্না শুরু করে ছেলে।

প্রেমার কোনো সম্পত্তি , গহনা, মূল্যবান কোনো জিনিস কিংবা রান্নাঘরের দামি কোনো তৈজসপত্র ছিল না-যা বিক্রি করে তিনি অর্থ পেতে পারেন।

প্রেমা বলেন , ‘আমার কাছে ১০ রুপিও ছিল না। শুধু প্লাস্টিকের বালতি ছিল।‘

ওই অবস্থায় প্রেমা বুঝতে পারেন, তার কাছে এমন কিছু আছে যা তিনি বিক্রি করতে পারেন।

প্রেমা বলেন, ‘একটি দোকানের কথা মনে আসে, যারা চুল কিনত। আমি সেখানে যাই এবং মাথার চুল ১৫০ রুপিতে বিক্রি করে দিই।’

বড় শহরের হিসেবে টাকার পরিমাণ খুব বড় না হলেও গ্রামে তিনি ওই টাকা তিনি তিন সন্তানের জন্য তিন প্যাকেট খাবার কিনেছিলেন।

কিন্তু ওটা সাময়িক স্বস্তি ছিল। প্রেমা জানতেন, তার আর কোনো উপায় নেই। এই ভাবনা তাকে বিপর্যস্ত করে তুলল।

মানসিক চাপ নিতে না পেরে প্রেমা জীবন শেষ করে দিতে একটি দোকানে কিছু কিনতে গেলেন। কিন্তু অবস্থা দেখে দোকানি কিছু একটা আঁচ করতে পেরে তার কাছে ওইদিন কিছু বিক্রি করেননি।

বাড়ি ফিরে প্রেমা নিজের জীবন শেষ করতে আবারও উপায় খুঁজছিলেন। কিন্তু সেইবার প্রেমার বোন এসে তার জীবন রক্ষা করেন।

কিছুদিন পর বালা মুরুগান নামের এক ব্যক্তি স্থানীয় এক ইটভাটার মালিক বন্ধুর কাছে প্রেমার অবস্থা সম্পর্কে জানতে পেরে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। কারণ বালা নিজেও চরম দারিদ্রতার মধ্যে বড় হয়েছেন। বালার মাও চাল কেনার জন্য সন্তানদের পুরনো বই আর পেপার বিক্রি করতেন।

দারিদ্রতা সহ্য করতে না পেরে একসময় বালার মাও নিজের ও সন্তানদের জীবন শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বালার মায়ের মন পরিবর্তন হয় তারা বেঁচে যান।

প্রেমার পরিস্থিতি বালাকে নিজের জীবনের কথা মনে করিয়ে দেয়। বালা ও তার এক বন্ধু তাৎক্ষণিকভাবে প্রেমাকে খাবার কেনার জন্য কিছু অর্থ সাহায্য দেন। পরে প্রেমা সম্পর্কে বালা সামাজিক মাধ্যমে এক পোস্ট শেয়ার করেন।

বালা বলেন, ‘একদিনে আমি ১ লাখ ২০ হাজার রুপি সাহায্য পেয়েছি। প্রেমাকে জানাতেই তিনি খুশি হন। প্রেমা বলেন, এই অর্থে তার বেশির ভাগ ঋণ পরিশোধ হয়ে যাবে।’পরে প্রেমার অনুরোধেই তিনি তহবিল তোলা বন্ধ করেন। বালাকে প্রেমা জানান, একটু সুস্থ হলে তিনি কাজে ফিরে যেতে পারবেন এবং বাকি ঋণ পরিশোধ করতে পারবেন।

প্রেমা এখন পাওনাদারদের মাসে ৭০০ রুপি করে শোধ দিতে পারেন। এর মধ্যে জেলা কর্তৃপক্ষ প্রেমাকে দুধের ডিলারশিপের ব্যবস্থা করে দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে।

প্রেমা বলেন, ‘এখন আমি বুঝতে পারি আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। বাকী ঋণ পরিশোধের বিষয়ে আমি আত্মবিশ্বাসী।’

ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হলেও প্রেমার মতো লাখ লাখ মানুষ এখনও আহার জোটাতে প্রতিনিয়ত লড়াই করে যাচ্ছেন।  

এবি/রাতদিন