নীলফামারীর সৈয়দপুরে নিখোঁজের দীর্ঘ ছয় বছর পর পরিবারের কাছে ফিরে এলেন মানসিক ভারসাম্যহীন নারী স্বাধীনা বেগম (৫১)। রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের পরিচ্ছন্নতা কর্মী আয়েশা বেগমের বদৌলতে পরিবারের কাছে ফিরে আসতে পেরেছেন তিনি।
স্বাধীনা নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলা কামারপুকুর ইউনিয়নের পূর্ব অসুরখাইয়ের মো: আমুদ্দি মামুদের প্রথম স্ত্রী।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলা কামারপুকুর ইউনিয়নের উত্তর অসুরখাই ডাক্তারপাড়ার মৃত. আলাউদ্দিন ও মৃত জোবেদা বেগম দম্পতির মেয়ে স্বাধীনা (৫০)। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় জন্মগ্রহন করেন বলে বাবা-মা তাঁর নাম রাখেন স্বাধীনা। বিয়ের দেন পাশের গ্রাম পূর্ব অসুরখাইয়ের মো. আমুদ্দিনের সঙ্গে।
এক সময় গৃহবধূ স্বাধীনার স্বামী সন্তান নিয়ে এক সুখের সাজানোগোঁছানো সংসার ছিল। কিন্তু প্রায় এক যুগ আগে তিন সন্তানের জননী স্বাধীনা বেগমের মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। তিনি কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় তাঁর স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করেন। চরম অবহেলা আর উদাসীনতায় কখনও স্বামীর বাড়িতে কিংবা কখনও বাবা বাড়িতে ঠাঁই হয় তাঁর। এ অবস্থায় বাবার বাড়ি থেকে হঠাৎ একদিন নিখোঁজ হন মানসিক ভারসাম্যহীন গৃহবধূ স্বাধীনা।
পরিবারের সদস্যরা তাকে সম্ভাব্য বিভিন্ন জায়গায় অনেক খোঁজাখুঁজিও করেন। কিন্তু কোথাও কোন খোঁজ মিলেনি তাঁর।
এদিকে, প্রায় দুই বছর আগে রাজশাহীতে এক সড়ক দূর্ঘটনায় পায়ে ও মাথায় মারাত্মক আঘাত পান স্বাধীনা। স্থানীয়রা তাকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করেন।
ওই হাসপাতালের একজন পরিচ্ছন্নতা কর্মী আলেয়া বেগম। যিনি জনসেবার কারণে সম্মাননা লাভ করেছেন, তিনি স্বাধীনার দেখভালের দায়িত্ব নেন। এভাবে প্রায় দুই বছর তাঁর সেবায় দূর্ঘটনায় আহত স্বাধীনা অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেন।
মানসিক ভারসাম্যহীন গৃহবধূ স্বাধীনার সাথে বার বার কথা বলে তার নাম পরিচয় জানার অনেক চেষ্টা করেন হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতা কর্মী আয়েশা বেগম। এক দিন তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলার এক পর্যায়ে স্বাধীনা তাঁর বাড়ি সৈয়দপুরে বলে জানান।
স্বাধীনার কথাবার্তায় আয়েশা কিছুটা নিশ্চিত হন তাঁর বাড়ি সৈয়দপুরে কোথাও হবে। পরবর্তীতে স্বাধীনাকে তার পরিবারের সন্ধানে তাকে সাথে নিয়ে গত ১৭ মার্চ রাজশাহী থেকে রওয়ানা দিয়ে রাতে সৈয়দপুরে পৌঁছেন।
ওই রাতে সৈয়দপুর ১০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালেই স্বাধীনাকে নিয়ে রাতযাপন করেন আয়েশা। পর দিন সকালে তিনি স্বাধীনাকে নিয়ে সৈয়দপুর শহরের উপকন্ঠে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরেন। কিন্ত কেউই স্বাধীনার পরিচয় কিংবা পরিবারের খোঁজ নিতে পারিনি। পরবর্তীতে সৈয়দপুর থানায় গিয়েও কোন রকম সহযোগিতা মেলেনি।
এ অবস্থায় পরিচ্ছন্নতা কর্মী আয়েশা বেগম অনেকটা হতাশ ও নিরাশ হয়ে পড়েন এবং পুনরায় সৈয়দপুর ১০০ শয্যা হাসপাতালে ফিরে যান। স্বাধীনাকে নিয়ে এখন কি করবেন, কার কাছে তাকে রেখে যাবেন এমন চরম দুশ্চিতায় পড়েন তিনি।
এ অবস্থায় খবর পেয়ে স্থানীয় দুইজন সংবাদকর্মী সৈয়দপুর ১০০ শয্যা হাসপাতালে গিয়ে পরিচ্ছন্নতা কর্মী আয়েশা বেগমের সঙ্গে কথা বলছিলেন স্বাধীনার বিষয়ে। এ সময় সেখানে উপস্থিত হন হাসপাতালে মেয়ের চিকিৎসা করাতে আসা জনৈক বৃদ্ধ। তাঁর বাড়ি উপজেলা কামারপুকুর ইউনিয়নের অসুরখাই তোফায়েলের মোড় এলাকায়। তিনি স্বাধীনাকে দেখে এবং তাঁর সঙ্গে অনেক সময় ধরে কথা বলার এক পর্যায়ে স্বাধীনার পরিচয় বের হয়ে আসে।
পরবর্তীতে ওই বৃদ্ধ ও একজন সংবাদকর্মীর সহায়তায় দীর্ঘ ৬ বছর নিখোঁজ থাকা স্বাধীনাকে তাঁর পরিবারের সদস্যদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। এ সময় স্বাধীনাকে কাছ পেয়ে তাঁর স্বামী আমুদ্দিন, ভাই জোবায়দুল ইসলামসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন।
রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতা কর্মী আয়েশা বেগম বলেন, এতোদিন মানবিক ভারসাম্যহীন নারী স্বাধীনাকে নিয়ে ভীষণ দুশ্চিতায় ছিলাম। কারণ তিনি পায়ে দূর্ঘটনাজনিত কারণে হাঁটাচলা করতে পারেন না। আমি ওর জন্য একটি ক্র্যাচারের ব্যবস্থা করেছি। আজ স্বাধীনাকে তাঁর পরিবারের হাতে তুলে দিতে পেরে আমি অনেকটা দায়িত্ব ও ভারমুক্ত হলাম।