করোনাভাইরাসের লক্ষণ ও করণীয়

করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ হলো সার্স কোভ-২ নামক করোনাভিরিডি গোত্রের একটি ভাইরাস ঘটিত রোগ। এ ভাইরাসে আক্রান্তের মধ্যে মধ্যে ৮১ ভাগের লক্ষণ মৃদু, ১৪ ভাগের তীব্র এবং প্রায় ৫ ভাগের সংকটাপন্ন।

কোভিড-১৯ রোগের মৃদু লক্ষণে সাধারণত জ্বর এবং কাশি থাকে, নিউমোনিয়া থাকে না এবং থাকলেও সেটা হালকা মাত্রার। মাঝারি বা তীব্র কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে জ্বর এবং কাশির সাথে শ্বাসকষ্ট এবং হাইপক্সিয়া থাকতে পারে। সংকটাপন্ন রোগীদের রক্তসংবহনতন্ত্রের বিকলাবস্থা এবং ফুসফুসের বিকলাঙ্গতা দেখা দেয়, বিভিন্ন অঙ্গের কর্মক্ষমতা লোপ পায় এবং এর মধ্যে কিছু রোগীর মৃত্যু হয়।

সাধারণ মানুষ এখন জ্বর, কাশি, সর্দি, শ্বাসকষ্ট থাকলেই মারাত্মক ভাবে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। অনেক সময় সমাজের মানুষের কাছে হেনস্থা হবার ভয়ে লুকিয়ে রাখছেন এই লক্ষণগুলো। ডাক্তার দেখাতে ভয় পাচ্ছেন। অন্য দিকে অনেক ডাক্তার জ্বর, কাশি, সর্দি, শ্বাসকষ্ট থাকলে কোভিড-১৯ রোগী সন্দেহে রোগীকে দেখতে ভয় পাচ্ছেন ও রোগী না দেখে ফিরিয়ে দিচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে কোভিড-১৯ রোগীর এই মূল উপসর্গগুলো জনসাধারণের আরো বিস্তারিত জানা দরকার।

প্রথমেই জেনে রাখা দরকার, কোভিড-১৯ এর জীবাণু শরীরে প্রবেশের পর এর লক্ষণ শুরু হতে সময় লাগে ২ থেকে ১৪ দিন এবং গড়ে ৫ দিন।

১। জ্বর: বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই করোনাভাইরাসের লক্ষণ শুরু হয় জ্বর দিয়ে। চীনের কয়েকটি গবেষণা পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত ৮২-৮৭ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে জ্বর হয়। জ্বর হলো শরীরের এমন একটি অবস্থা যখন শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক তাপমাত্রার চেয়ে বেড়ে যায়। পূর্ণ বয়স্ক মানব শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রার রেঞ্জ হলো ৯৭ থেকে ৯৯ ডিগ্রী ফারেনহাইট এবং গড় তাপমাত্রা ৯৮.৬ ডিগ্রী ফারেনহাইট। শরীরের তাপমাত্রা ১০০.৪ ডিগ্রী ফারেনহাইটের বেশি হলেই জ্বর বলা যাবে। তাপমাত্রা ১০৩.১ ডিগ্রী ফারেনহাইটের ওপরে গেলে বলা হয় উচ্চ মাত্রার জ্বর এবং ১০৫.৮ ডিগ্রী ফারেনহাইটের উপরে গেলে বলা হয় অতি উচ্চ তাপমাত্রার জ্বর। শরীরের তাপমাত্রা দিনের সময় অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়। শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা সকালে কম থাকে এবং বিকেলে বেশি থাকে। ব্যক্তির বয়স এবং লিঙ্গভেদেও স্বাভাবিক তাপমাত্রা কম-বেশি হতে পারে। যেমন শিশুদের শরীরের তাপমাত্রা প্রাপ্তবয়স্কদের থেকে বেশি হয়। শিশুদের স্বাভাবিক তাপমাত্রার রেঞ্জ হলো ৯৫.৯ থেকে ৯৯.৫ ডিগ্রী ফারেনহাইট (জিহ্বার নিচে)।

জ্বর কোনো রোগ নয়। এটি শরীরে জীবাণু সংক্রমণ অথবা অন্য কোনো অসুস্থতার লক্ষণ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে জীবাণু সংক্রমণের কারণে জ্বর হয়। শরীরের জ্বর আসা মানে হলো শরীর ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করার চেষ্টা চালাচ্ছে। শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় সংক্রমণের জীবাণু দ্রুত বংশবিস্তার করে, কিন্তু শরীরের তাপমাত্রা বাড়লে সেগুলো আর সুবিধা করে পারে না ও ধ্বংস হয়ে যায়। জ্বর শরীরের রোগপ্রতিরোধ শক্তিকেও সক্রিয় করে। তাই হালকা জ্বর হলে ওষুধ সেবন না করাই উত্তম। প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে জ্বর ১০৩.১ ডিগ্রী ফারেনহাইট ও শিশুদের ক্ষেত্রে ১০২.২ ডিগ্রী ফারেনহাইটের বেশি জ্বর দেখা দিলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।

২। কাশি: করোনাভাইরাসের আরেকটি অন্যতম লক্ষণ হলো শুষ্ক কাশি। প্রায় ৬৫% রোগীর ক্ষেত্রে শুষ্ক কাশি দেখা গেছে। এটা সাধারণত জ্বরের সাথে বা কাছাকাছি সময়ে শুরু হয়। কি রকম কাশি হলে এটা কোভিভ-১৯ হতে পারে তা যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস বেশ ভালোভাবে ব্যাখ্যা করেছে। ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস বলছে কাশিটা হবে নতুন (কারণ অনেকের অ্যাজমা, ব্রঙ্কাইটিস বা পুরাতন কাশি থাকতে পারে) এবং দিনে দুই-তিন বার একনাগাড়ে অনেকক্ষণ কাশি হবে। যাদের পুরাতন কাশি আছে তাদের কাশির তীব্রতা আগের চেয়ে অনেক বেশি হবে।

কাশি হলো এক প্রকার আকস্মিক প্রতিক্রিয়া বা রক্ষাকারী প্রক্রিয়া যা বিভিন্ন ধরনের ক্ষরণ, বহিঃস্থ কোনো বস্তু বা বিরক্তিকর-উত্তেজক বস্তু থেকে শ্বাসনালীকে রক্ষা করে। শুষ্ক কাশিতে শ্লেষ্মা বের হয় না। কিন্তু আরেক প্রকারের কাশি হয় যাতে শ্লেষ্মা (মিউকাস) তৈরি হয়। এ প্রকারের কাশিকে ইংরেজিতে ময়েস্ট কফ বলে। কাশির স্থায়িত্বের ওপর কাশিকে অ্যাকিউট (তিন সপ্তাহ) পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এ ধরনেরর কাশি সাধারণ ঠান্ডা লাগা, ফ্লু ইত্যাদি কারণে হয়, সাব-অ্যাকিউট (তিন থেকে চার সপ্তাহ স্থায়ী হয়) এবং ক্রনিক বা দীর্ঘস্থায়ী কাশি (চার সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হয়) এই তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যেসব কারণে কাশি হয় তার মধ্যে আছে- কোভিভ-১৯, অ্যালার্জি, অ্যাজমা, ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিজ, ইনফ্লুয়েঞ্জা, সাধারণ ঠাণ্ডা লাগা, শ্বাসনালীর তীব্র প্রদাহ ইত্যাদি। আরও কিছু কারণ রয়েছে যেমন- এসিই ইনহিবিটর গ্রুপের উচ্চরক্তচাপে ব্যবহৃত ওষুধসমূহ (ক্যাপটোপ্রিল, এনালাপ্রিল ইত্যাদি), ধূমপান, ফুসফুসের ক্যান্সার, দূষিত বাতাস, শ্বাসনালীকে উত্তেজিত করে এমন পদার্থ, গ্যাস্ট্রোএসোফিজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ ইত্যাদি।

গবেষণায় দেখা গেছে, একবার কাশিতে লালা এবং মিউকাস দিয়ে তৈরি প্রায় ৩,০০০ ছোট ছোট কণিকা বা respiratory droplets (৫ মাইক্রোমিটার ব্যাস আকৃতির বা তার চেয়ে কম) তৈরি হতে পারে, যার মধ্যে কিছু কিছু কণিকা প্রায় ৫০ মাইল বেগে মুখ থেকে বের হয়ে আসে। কাশির মাধ্যমে বের হয়ে আসা এই অপেক্ষাকৃত বড় কণিকাগুলো (৫ মাইক্রোমিটার ব্যাস আকৃতির) সাধারণত ১ মিটার (প্রায় তিন ফিট) দূরত্ব পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। তবে কণিকার আকৃতি ৫ মাইক্রোমিটারের ছোট হলে সেগুলো প্রায় ৬ মিটার (প্রায় ২০ ফিট) পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে। ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াজনিত শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের কারণে কাশি হলে লালার এই ক্ষুদ্র কণিকাগুলো হাজার হাজার জীবাণু পরিবেশে ছড়িয়ে দেয়। তাই কাশি হলে মুখে রুমাল বা টিস্যু দিয়ে ঢাকতে হয় অথবা কনুইয়ের ভাঁজে মুখ ঢেকে কাশি দিতে হয়। তবে জনে রাখা দরকার, রেস্পিরেটরি ড্রপলেটস বা কণিকাগুলি শুধু কাশির মাধ্যমে ছড়ায় না। কথা বলা, শ্বাস ফেলা, গান গাওয়া এবং হাঁচি দেয়ার মাধ্যমেও এরা ছড়িয়ে পড়ে।

৩। শ্বাসকষ্ট: কোন ব্যক্তি কোভিভ-১৯ দ্বারা সংক্রমিত হলে ইনকিউবেশন পিরিয়ড শেষে সাধারণত জ্বর এবং কাশি দিয়ে লক্ষণ প্রকাশ পায়। অনেকের প্রথম দিকে গা ব্যথা, গলা ব্যথা, অবসাদ, শারীরিক দুর্বলতাও থাকতে পারে। শ্বাসকষ্ট সাধারণত লক্ষণ প্রকাশের পাঁচ দিনের পর দেখা দেয়। শ্বাসকষ্ট তীব্র মাত্রার কোভিভ-১৯ অন্যতম লক্ষণ। চীনের রোগীদের ওপর পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, মৃদু লক্ষণের প্রায় পাঁচ ভাগ রোগীর ও তীব্র লক্ষণের প্রায় ৪৪ ভাগ রোগীর শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। কোভিভ-১৯ ছাড়াও আরো অনেক রোগে শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়, যেমন- অ্যাজমা, ক্রনিক অবসট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিজ, হার্ট অ্যাটাক, নিউমোনিয়া, মানসিক উদ্বেগ বা উৎকণ্ঠা, ফুসফুসে রক্ত জমাট বাধা ইত্যাদি।

৪। অ্যানোসমিয়া বা ঘ্রাণশক্তি হীনতা: অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর এভিডেন্সড বেইজড মেডিসিনের একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, কোভিভ-১৯ এ আক্রান্ত রোগীদের ঘ্রাণশক্তি লোপ পাওয়ার সম্ভাবনা অন্যান্য রোগীদের থেকে প্রায় তিন গুণ হয়ে থাকে। তবে ফ্লু, সাধারণ ঠান্ডা লাগা সমস্যায়ও অনেকের সাময়িক ঘ্রাণশক্তি লোপ পায়।

কোভিভ-১৯ মারাত্মক ছোঁয়াচে রোগ। তাই রোগীর লক্ষণ দেখা দেয়ার সাথে সাথে অন্যের থেকে নিজেকে থাকে আলাদা করে, পরিবারের অন্য সদস্যদেরসহ সমাজের মানুষকে সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচাতে পারে। তবে রোগীর পরিবার ও সমাজের মানুষের দায়িত্ব হল রোগীকে মানসিকভাবে শক্তি যুগিয়ে যাওয়া ও রোগীকে সুস্থ হয়ে উঠতে পর্যাপ্ত সেবা-শুশ্রুষা করা। তবে শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে, বুকে অস্বাভাবিক চাপ অনুভব করলে, ঠোঁট বা মুখ নীল হয়ে আসলে দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিতে হবে। আর অসুস্থ রোগী এবং তার যারা যত্ন নিবেন তাদের অবশ্যই মাস্ক বা মুখে কাপড় বেঁধে রাখতে হবে এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।