তপ্ত দুপুরে গাছের ছায়ায় রঙিন প্যান্ডেল। ভেতরে একাধিক বৈদ্যুতিক পাখা। সাজানো টেবিলে নানা পদের খাবার। মেন্যুতে রয়েছে পোলাও, মাংস, ডিম, ডাল, মিষ্টি, কোমলপানীয়। দামি কাপড়ে মোড়ানো চেয়ারে বসে পরম তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছেন ‘অতিথি’রা। খাওয়া শেষে মূল প্যান্ডেলের বাইরে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে টিস্যুতে মুছছেন। এরপর টেবিলে রাখা পান-সুপারি মুখে পুরে চিবোচ্ছেন।
পুরো আয়োজনটি চমৎকারভাবে সাজানো। মনে হতে পারে হয়তো নামীদামী বা বড়লোকদের জন্য এ আয়োজন। যারা পরিপাটি কাপড়চোপড়ে সেজেগুজে বিয়ে, বৌভাত বা অন্যকোনো অনুষ্ঠানের দাওয়াতে এসেছেন।
তবে এ আয়োজনের যারা ‘অতিথি’-তাদের বেশিরভাগের পরিধেয় কাপড় মলিন, কারো ছেঁড়া। অনেকের পায়ে নেই স্যান্ডেল। আর যারা সেই অতিথিদের অ্যাপায়ন করছেন তাদেরই পোষাক চকচকে। ব্যতিক্রমি এই আয়োজনে মূলত সমাজের পিছিয়েপরা ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষদেরই অতিথি হিসাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।
সোমবার, ১১জুলাই দুপুরে লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ কেইউপি উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠ লাগোয়া একটি জায়গায় ঈদ উপলক্ষে এ আয়োজন করা হয়েছিল। যেখানে অসহায়, দরিদ্র কিংবা প্রতিবন্ধী শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত অন্তত ২৫০জন মানুষ অত্যন্ত সন্মানের সাথে আপ্যায়িত হয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছেন।
স্থানীয় নানা পেশার কয়েকজন মানুষ পবিত্র ঈদুল আযহা উপলক্ষে দ্বিতীয়বারের মতো এ আয়োজন করেছিলেন সোমবার। অনুষ্ঠানের নাম দেয়া হয়েছিল ‘ঈদে কষ্ট মানুষের পাশে’।
আয়োজকরা জানিয়েছেন, ঈদে নিজেদের বাড়িতে দেয়া কোরবানির মাংস তারা একত্রিত করেছেন। এরপর নিজেরাই টাকা দিয়ে বাকি আয়োজন করেছেন। সামাজিক কোনো অনুষ্ঠান কিংবা ঈদে যেসব মানুষদের সাধারণত কেউ দাওয়াত দেয়না মূলত তাদেরই দাওয়াত দিয়ে আপ্যায়িত করা হয়েছে এ আয়োজনে।
অনুষ্ঠানে অতিথি হিসাবে আসা ৮০ বছরের বৃদ্ধ আব্দুল খালেক বলেন, ঈদের আগেই বাড়িতে গিয়ে সম্মানের সাথে দাওয়াত দিয়েছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। দাওয়াতে এসে এত খাবার দেখে নিশ্বাস ফেলেছিলাম। চিন্তা করেছিলাম এত খাবার কি খেতে পারবো। তাদের আপ্যায়নে মন ভরে খেয়েছি, এই সম্মান ও খাবারের কথা কোনদিন ভুলব না।
রোকসানা বেগম বলেন, ‘ভিক্ষা করতে গিয়ে অনেক বাড়ির সামনে দাড়িয়ে থাকি। অনেকেই আমাদের তাড়িয়ে দেন। কিন্তু এই দাওয়াতে যা পেলাম তা অবাক করার মত। তাদের অয়োজন দেখে ভাবছিলাম আমরা বুঝি বড় লোকের কোন সন্তান। যারা এই আয়োজন করেছেন আল্লাহ তাদের আরও বড় করুক।
আসমা বেগম নামের আরেক নারী বলছিলেন, গত বছর তাদের দাওয়াতে এসেছিলাম। তখনও আমাদের চেয়ার-টেবিলে বসিয়ে খাইয়েছে। তাই গত এক বছর এই দাওয়াতের অপেক্ষা করেছি।
করোনা কালীন সমযয়ে কাজ না পেয়ে অনেকে কষ্টে ছিল। তাদের কথা চিন্তা করে অনুষ্ঠানের নাম দেয়া হয়েছিল ‘ঈদে কষ্ট মানুষের পাশে’। আর এই নামের কারিগর হচ্ছেন ৯বছরের ছোট মেয়ে হিসনে হাসিন। তার মাথায় থেকে আসে এই চিন্তা। তারা মা শিক্ষিকা আরিফা সুলতানা বলেন, করোনাকালে শত শত মানুষ না খেয়ে কষ্ট ছিল। এসব চিত্র দেখে মেয়ে তাদের মুখে খাবার তুলে দিতে বলেছিল। ওই সময় তার বাবা সাংবাদিক হায়দার আলী বাবু উদ্যেগ নিলে সেটি সফল হয়। এগিয়ে আসেন অনেক সেচ্ছসেবী যবুক। ভালো কাজের সাথে সবাই থাকে, তাই ভাবছি পরেরবার আরও বড় করে আয়োজনটি করা হবে।
আয়োজকদের একজন আজাদ আলী বলেন, বিভিন্ন পেশার কয়েকজন মানুষ মিলে আমাদের এ আয়োজন। আমরা সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের মুখে অন্তত একদিন সাধ্যমত সম্মানের সাথে খাবার তুলে দিতে পারি-এরকম চিন্তা থেকেই এই আয়োজন।
আরেক আয়োজক রেফাজ রাঙ্গা বলেন, উদ্যোগটি মূলত সাংবাদিক হায়দার আলী বাবুর। এই আয়োজনে জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রাকিবুজ্জামান আহমেদসহ আমরা অনেকে যুক্ত হয়ে সামান্য কিছু করার চেষ্টা করেছি মাত্র। আমরা চাই আমাদের মতো সারাদেশেই এ ধরণের আয়োজন হোক।
আয়োজনের মূল উদ্যোক্তা সাংবাদিক হায়দার আলী বাবু বলেন, সুবিধাবঞ্চিত কিংবা দরিদ্র মানুষ আমাদের ভাষায় ‘কষ্টমানুষ’। করোনা মহামারির সময় কষ্টমানুষ প্রজেক্টের আওতায় কর্মহীন নানা পেশার মানুষদের জন্য আমরা ত্রাণ সহায়তা করেছি কয়েকদফা। আর গত বছর ঈদুল আযহার পরদিন পুরোপুরি আয়োজন করে দরিদ্র মানুষদের আপ্যায়ন করার কাজটি শুরু করেছি।
আগামিতে আমাদের চেষ্টা থাকবে একাধিক স্থানে এ ধরণের আয়োজন করার- বলছিলেন আয়োজনের মূল উদ্যোক্তা সাংবাদিক হায়দার আলী বাবু।