শুধুমাত্র বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার একাংশে এবার ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ প্রায় মহামারির পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে। ফিলিপাইন,থাইল্যান্ডসহ কয়েকটি দেশে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে জরুরি অবস্থা জারি করেছে দেশগুলো। এডিসের বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধ শুরু করেছে ইন্দোনেশিয়া। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে এটি এলো কোত্থেকে?
বাংলাদেশে ডেঙ্গু:
পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার প্রজাতির মশা রয়েছে। এদের মধ্যে এডিস এজিপ্টি সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। যাকে আমরা এডিস মশা বলি। এই মশাই ডেঙ্গুর ভাইরাসবাহী। এধরনের মশা ডেঙ্গু ছাড়াও জিকা ও চিকনগুনিয়ার বাহক। পরিষ্কার পানিতে জন্ম নেয়া স্বল্পায়ুর মশাই মুর্তিমান আতংক হয়ে দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিটিউট এর (আইইডিসিআর)প্রকাশিত গবেষণায় দেখা যায়, ডেঙ্গু জ্বর রোগটি প্রথম ১৯৫২ সালে আফ্রিকাতে দেখা যায়। পরবর্তীতে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ যেমন- ভারত, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার এবং ইন্দোনেশিয়াতে এটি বিস্তার লাভ করে।
বাংলাদেশে ২০০০ সালে প্রথম এডিসবাহিত ডেঙ্গু রোগীর সন্ধান পাওয়া যায়।সে বছর মৃতের সংখ্যাও প্রায় শত ছুঁয়েছিল।
পরের বছরগুলোতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলেও সংখ্যা অনেক কমে আসে। ২০১৫ সালের পর ডেঙ্গু আবার বাড়তে থাকে। সে বছর আক্রান্ত হন ২৬৭৭ জন। আর গত বছরএই সংখ্যা অনেকটাই বেড়ে যায়।
প্রাচীনকালে ডেঙ্গু:
ইতিহাসে ডেঙ্গু মহামারীর প্রথম তথ্য জানা যায় চীনে। খ্রিস্টপূর্ব ২৬৫-৪২০ অব্দে জিন সাম্রাজ্যের সময় এ রোগের প্রাদুর্ভাবের কথা জানা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও ডেঙ্গু বিভিন্ন দেশে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে।
ডেঙ্গু নামকরন:
স্প্যানিশ ডেঙ্গু শব্দ এ রোগের নামকরণ হয়। যার অর্থ হাড়ভাঙা জ্বর। তবে স্পেনে শব্দটি এসেছে পূর্ব আফ্রিকার সোহাইলি আদিবাসীদের কাছ থেকে। তাদের বিশ্বাস ছিল ‘খারাপ আত্মার সংস্পর্শে হাড়গোড় ভাঙার ব্যথাঅলা’ এ জ্বর হয়।
জানা যায়, ওয়েস্ট ইন্ডিজের গোলামদের যদি ডেঙ্গু জ্বর হতো তখন তাদের হাটার ভঙ্গিমা ডান্ডি নৌকার মত দেখা যেত, তা থেকে ডান্ডি জ্বর বলা হত, ধীরে ধীরে ডেঙ্গু নাম ধারণ করেছে।
মশা নিয়ে একটি গবেষনাগ্রন্থ থেকে জানা যায়, ১৯৭৯-৮০ সালে এশিয়া, আফ্রিকা ও উত্তর আমেরিকা ডেঙ্গু মহামারিতে পরিনত হয় তখন থেকেই বিষয়টি আলোচনায় আসে।
এশিয়ায় ডেঙ্গু এলো যেভাবে:
এনসাইক্লোপেডিয়া বলছে, ইউরোপীয় উপনিবেশ স্থাপনকারীরা আফ্রিকা থেকে মশার এই জাতকে সমুদ্র পার করে আমেরিকা ও এশিয়ায় নিয়ে আসেন বলে গবেষকদের ধারণা। বহুদিন ধরেই ‘পীত জ্বরের’ বাহক হিসেবে পরিচিত এই এডিস মশা। ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইউরিয়েল কির্টন ডেঙ্গু ও জিকার প্রাদুর্ভাবের জন্য নগরায়নের ধরনকেও দায়ী করেছেন।
তার মতে, গত সাত দশকে নগরায়নের হার ২০ থেকে বেড়ে ৮০ শতাংশ হওয়াও এডিস এজিপ্টির বিস্তার বাড়ার অন্যতম কারণ। বংশবৃদ্ধির জন্য এ মশা ফুলের টবের মতো ছোট ও বদ্ধ পাত্রে সহজেই ডিম পাড়তে পারে।
বিশ্বব্যাপী ডেঙ্গুর ভয়াবহতা:
১৯৬২ সালে আমেরিকা মহাদেশের ১৮টি দেশ থেকে এডিস এজিপ্টিকে ‘নির্মূল’ করা হয়েছিল।
ডেঙ্গু মহামারীর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রথম বিবরণ পাওয়া যায় ১৭৭৯ ও ১৭৮০তে, যখন এক মহামারীর কবলে পড়েছিল এশিয়া, আফ্রিকা ও উত্তর আমেরিকা। ১৯০৬ সালে এডিস মশার পরিবাহিতা সম্পর্কে সবাই নিশ্চিত হন, এবং ১৯০৭ সালে ভাইরাস ঘটিত রোগের মধ্যে ডেঙ্গু হয়ে ওঠে দ্বিতীয়। এই জ্বরের এই চরম রূপের বিবরণ ১৯৫৩ সালে প্রথম ফিলিপাইনে পাওয়া যায়; ১৯৭০-এ এটি শিশু মৃত্যুর এক প্রধান কারণ হয়ে ওঠে এবং আমেরিকা ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়।
আশার কথা:
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ মুহূর্তে পাঁচটি ডেঙ্গু ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা চলছে। এর মধ্যে দু’টি প্রায় শেষপর্যায়ে। তবে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের আগে ডেঙ্গু প্রতিরোধ করতে হলে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করা ছাড়া বিকল্প নেই, প্রয়োজন সচেতনতা।
জেএম/রাতদিন