পীরগঞ্জের ভেন্ডাবাড়ী পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের হাজতে (ফাঁড়ি) এক ব্যবসায়ীর মৃত্যুতে ডাকা অবরোধে গত বুধবার, ১৬ অক্টোবর ৮ পুলিশ আহত হন। ওই পুলিশ কেন্দ্রের ইনচার্জ (আইসি) আমিনুল ইসলামের বিচারের দাবীতে শত শত ভুক্তভোগী ওইদিন শ্লোগান দিয়ে রাস্তা অবরোধ, তদন্ত কেন্দ্র ঘেরাও করে পুলিশের উপর ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করলে আহতের এই ঘটনা ঘটে।
পুলিশ জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে শতাধিক রাউন্ড রাবার বুলেট ছুড়লে কমপক্ষে ২৫ জন বুলেটবিদ্ধ হয়। ওই আইসি এবং তার এক সোর্সের অত্যাচার ও নির্যাতনে অতিষ্ঠ হাজারো মানুষ এদিন বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। পরে ওই আইসিসহ ৫ পুলিশকে ক্লোজড করায় স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছে মানুষজন। ভেন্ডাবাড়ী এলাকায় আইসি’র নির্মম নির্যাতনের ঘটনা বেরিয়ে আসছে একের পর এক।
জানা গেছে, বিগত ১৯৯৯ সালের ৮ এপ্রিল পীরগঞ্জের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ৬টি ইউনিয়নের আইন-শৃংখলা নিয়ন্ত্রনে ভেন্ডাবাড়ী পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র স্থাপিত হয়। ২০০৩ সালে নতুন ভবনে কার্যক্রম শুরু করে। ফাঁড়িতে শুধু জিডি, অভিযোগ, মাদক ও মামলার তদন্ত কার্যক্রম এবং তাৎক্ষণিক সমস্যা মনিটরিং করা হত।
ওই কেন্দ্রে ২০১৮ সালের ৬ অক্টোবর ২২তম ইনচার্জ হিসেবে (পুলিশ পরিদর্শক) আমিনুল ইসলাম যোগদান করেন। তার যোগদানের পর থেকেই তিনি ওই এলাকায় ভয়ংকর মুর্তিমান আতংক হয়ে উঠেন। এলাকাবাসী তাকে ‘ফাঁটাকেষ্ট’ উপাধি দেন। কারণ তিনি নানান ছলছুতোয় সাধারন মানুষকে আটকে মারপিট, মাদক মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়ার হুমকি এবং টাকা আদায়ে অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন বলে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
এলাকাবাসী অভিযোগ, ফাঁড়ির হাজতখানাটি যেন আইসি আমিনুল ইসলামের টর্চার সেল। অসংখ্য মানুষ এমন নির্মম নির্যাতনের বর্ননাও দিয়েছেন। আটক বানিজ্য নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৫ অক্টোবর সন্ধ্যায় পার্শবর্তী মিঠাপুকুর উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের শান্তিপুর গ্রামের মৃত. মফিজ উদ্দিনের ছেলে ছাগল ব্যবসায়ী শামছুল হক (৫৫) কে পীরগঞ্জের বড়দরগা বাসষ্ট্যান্ড থেকে চোলাই মদ সেবনের অভিযোগে ওই আইসি ধরে নিয়ে যান।
হাজতে থাকা শামছুলকে ছেড়ে দিতে শামছুলের পরিবারের কাছে ৫০ হাজার টাকা দাবী করে ওই আইসি। টাকা না দেয়ায় শামছুলের নামে ২৫ লিটার চোলাই মদের মামলা হয়।
এ ঘটনার পর ১৬ অক্টোবর সকাল পৌনে ৯টার দিকে হাজতের জানালার গ্রিলের সাথে সামসুলের গলায় ফাঁস লাগানো লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
ঘটনাটি ছড়িয়ে পড়লে ওই আইসি’র নির্যাতনের শিকার এলাকার শত শত মানুষ ক্ষোভে ফেঁটে পড়েন। ভুক্তভোগীরাও ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢালেন। একপর্যায়ে ফাঁড়িটি ঘেরাও করে জনতা ইট-পাটকেল ছুড়লে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হাফিজুর রহমান, ওসি সরেস চন্দ্রসহ ৮ পুলিশ আহত হন।
জনতাকে ছত্তভঙ্গ করতে পুলিশের ছোড়া রাবার বুলেটে উপজেলার কলোনীবাজারের আঃ কাদের, চকবরখোদার তরিকুল, পাকুড়িয়ার রনিসহ ২৫জন গুলিবিদ্ধ হন। ওই ঘটনায় আইসি আমিনুল, এএসআই হরিকান্ত বর্মন ও তাজ উদ্দিন, কনষ্টেবল ভুপেন ও শাহ কামালকে ক্লোজ করা হয়।
অপরদিকে ওই আইসি’র সোর্স রংপুরের পাগলাপীরের জিয়াউর রহমান জিয়া এলাকাবাসীর কাছে ছিলেন গোদের উপর বিষফোঁড়া। সে সেকেন্ড আইসি হিসেবে পরিচিত ছিল। তাকে গ্রেফতার করলে অনেক অপকর্মের তথ্য পাওয়া যাবে বলে এলাকাবাসী জানান।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আইসি আমিনুলের নির্যাতনের শিকার গুর্জিপাড়ার পুলিশেরই এক দারোগার ছেলে নিশাত মিয়া। সে ওই আইসি’র মোটর সাইকেলকে ওভারটেক করায় থানায় নিয়ে গিয়ে বেদম পেটায়। একপর্যায়ে মাদকের মামলার ভয় দেখিয়ে ওই দারোগার পরিবারের কাছে ৫০ হাজার টাকা নেয়।
এ ছাড়াও মাদকের মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দিয়ে নির্যাতন করে পার্বতীপুরের রিয়ন মিয়ার (১৭) কাছে ৩০ হাজার টাকা, নগদ এসআর এর চাকরীজীবি রুবেল মিয়ার কাছে ৫০ হাজার, গুর্জিপাড়ার চাকরীজীবি আতিয়ার রহমানসহ ৬ জনকে ধরে নিয়ে গিয়ে ৪৮ হাজার, ভেন্ডাবাড়ীর জুতার মিস্ত্রি (মুচি) রামনালের কাছে ১০ হাজার, কলা ব্যবসায়ী শাহীনুরের কাছে ২০ হাজার, মথুরাপুরের ব্যবসায়ী রায়হানের কাছে ২০ হাজার, ভেন্ডাবাড়ীহাটের ব্যবসায়ী জোনাব আলী ও তার ছেলেকে পেটাতে পেটাতে তদন্ত কেন্দ্রে নিয়েও নির্যাতনের পর টাকা নেয়। অনেককে ছেড়েও দেয়।
এ রকম অহরহ আটক-বানিজ্যের সুষ্পষ্ট তথ্য পাওয়া গেছে। গুর্জিপাড়ার ফার্নিচার ব্যবসায়ীর শ্রমিক সুজন মিয়ার কাছে সোফা সেট নিয়ে ২০ হাজার টাকা দেয়নি। উল্টো তাকে মাদক মামলার ভয় দেখিয়েছেন ওই পুলিশ কর্মকর্তা।
গুর্জিপাড়ার প্রতিষ্ঠিত গালামাল ব্যবসায়ী আলহাজ খালেক মিয়ার কাছে দেড় লক্ষ টাকা দাবী করে। তা না দেয়ায় তাকে মাদক মামলায় চালান করলে ৪ দিন তিনি হাজতবাস করেন।
এ রকম অসংখ্য মানুষের আহাজারিতে ভরপুর ভেন্ডাবাড়ী। ভেন্ডাবাড়ী ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ড আ’লীগের সভাপতি মোস্তাফিজার রহমান বলেন, তদন্ত কেন্দ্রের হাজতখানাটি যেন আমিনুলের টর্চার সেল হয়ে উঠেছিল। টাকা না পেলে নির্মম নির্যাতন করতো। সে এক বছরে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল এলাকাবাসী। এখন স্বস্তিতে আছি।
নতুন আইসি সুশান্ত বলেন, ভেন্ডাবাড়ীর মানুষ শান্তিপ্রিয়। বর্তমানে এলাকা শান্ত এবং পুলিশ টহল রয়েছে। রংপুরের পুলিশ সুপার বিপ্লব কুমার সরকার রাতদিননিউজকে বলেন, পুলিশ জনবান্ধব, প্রতিপক্ষ নয়। তাই ভেন্ডাবাড়ী তদন্ত কেন্দ্রে অনাকাংখিত ঘটনায় ৩ সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। কমিটির প্রতিবেদনে বিন্দুমাত্র অপরাধ পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ জন্য জনতার সহযোগিতা চাই।
অন্যদিকে হাজতখানায় শামছুলের মৃত্যুতে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে তার পরিবার দিশেহারা। তার স্ত্রী মমেনা বেগম, জামাই নুরুজ্জামানসহ এলাকাবাসী শামছুল হত্যা এবং আইসি আমিনুলের বিচার দাবী করেছেন।
এসকে/রাতদিন