পৃথিবী থেকেই হারিয়ে যাচ্ছে শংকরদহ! ত্রাণ নয়, বাঁধ চান গঙ্গাচড়ার মানুষ

‘থাকার জায়গা না থাইকলে বাড়ি করি থাকমো কোটে, আর ত্রাণ নিয়া আন্দাবাড়া (রান্নাবান্না) করি কোটে খামো’ -কান্না জড়িত কণ্ঠে এই কথাগুলো বলছিলেন মিটু মিয়া। মিটু ‍মিয়ার বাড়ী রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার লক্ষীটারী ইউনিয়নের চর শংকরদহ গ্রামে। যে গ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকা এরই মধ্যে তিস্তার ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে।

মিটু মিয়ার মত প্রায় ৩ শতাধিক পরিবারের বাড়িঘর বিলীন হয়ে গেছে তিস্তার দফায় দফায় ভাঙনে। এদের মধ্যে রয়েছেন এজাজুল মুন্সি, হালিম, তালেব, জয়নাল, নুর আলম, হয়রত, সিরাজুল, হাসান, দুলু, দুলাল, খরকু, নুর ইসলাম, ছমসেল, লাবলু, খোকা, মনোয়ারুল, জয়নাল, বাবলু, রশিদ, নুর আলম ও আক্তারুলের মতো অনেকগুলো পরিবার।

শংকরদহের অস্তিত্ব এখন শুধুই মানচিত্রে, বাস্তবে গ্রামটি আর নেই বললেই চলে।
গ্রামের বাড়ী যে ৭০-৮০টি বাড়ি রয়েছে তাও ভাঙার পথে। তিস্তা যেভাবে ভাঙছে তাতে যে কোন সময় ওই বাড়িগুলো বিলীন হয়ে শংকরদহ পুরো গ্রাম হারিয়ে যাবে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে।

এরইমধ্যে শংকরদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বিলীন হয়ে গেছে। বিলীনের অপেক্ষায় শংকরদহ বধ্যভূমি ও হাফিজিয়া মাদ্রাসা। এবারের বর্ষা মৌসুমে দফায় দফায় বন্যা আর বন্যার পানি কমার সাথে তিস্তার ভাঙন। ভাঙনে উপজেলার লক্ষীটারী ইউনিয়নের চর শংকরদহ, ইচলী, আশ্রয়ন গ্রাম, বাগেরহাট, চল্লিশসাল এলাকায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

কোলকোন্দ ইউনিয়নের বিনবিনা, চিলাখাল, খলাইচর, নোহালী ইউনিয়নের ফোটামারী, বৈরাতী, নোহালীর চর, আলমবিদিতর ইউনিয়নের গাটুপাড়া, হাজীপাড়া, পীরপাড়া, গজঘন্টা ইউনিয়নের ছালাপাক, কামদেব, রাজবল্লভ, মহিষাশুর, মর্ণেয়া ইউনিয়নের তালপট্টি, ভাঙাগড়া, আলালচর, নরসিং, আলেমার বাজারসহ তিস্তাবেষ্ঠিত বিভিন্ন এলাকায় তিস্তার ভাঙন অব্যাহত রয়েছে।

ফসলি জমিসহ ওইসব এলাকার মানুষের ঘরবাড়ি, গাছপালা, রাস্তা ঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট ভেঙে গেছে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। মানুষজন নৌকায় কোন রকম চলাচল করছে। বাড়ি ভাঙা মানুষগুলো কোন রকম এক-দুটা ঘর ও কিছু জিনিষপত্র সরিয়ে নিলেও তাদের বাড়ি নির্মাণ করে থাকার মত জায়গা না পেয়ে এসব ঘর রাস্তার ধারে ফেলে রেখেছে।

অনেকে আবার সুবিধামত জায়গা না পেয়ে তিস্তার চরে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় বাড়ি তৈরি করছেন। সরকারিভাবে বাড়ি ভাঙা ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোকে ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হলেও কিছু ক্ষতিগ্রস্থ পরিবার এখন পর্যন্ত আর্থিক সহায়তা পাননি। তবে কোলকোন্দ ইউপি চেয়ারম্যান সোহরাব আলী রাজু ও লক্ষীটারী ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল হাদী তিস্তার ভাঙন কবলিত মানুষের পাশে থেকে কাজ করছেন বলে জানা গেছে। তারা দিনরাত ওইসব মানুষের দ্বারে দ্বারে সরকারি সহায়তার পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবে সহায়তা পৌছে দিচ্ছেন।

তবে প্রতিবছর এই নির্মমতার হাত থেকে বাঁচতে ত্রাণ নয়, তিস্তার বামতীরে বাঁধ নির্মানের জোড়ালো দাবী করছেন এলাকাবাসী। তারা বলছেন, এতে করে এই এলাকসহ একটি বিস্তীর্ণ এলাকা ভাঙনের কবল থেকে মুক্তি পাবে।

রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড জিও ব্যাগে স্থাপনের মাধ্যমে ভাঙন কবলিত এলাকা রক্ষায় কাজ করছেন। জেলা প্রশাসক আসিব আহসান, উপজেলা চেয়ারম্যান রুহুল আমিন, উপজেলা নির্বাহী অফিসার তাসলীমা বেগম সম্প্রতি তিস্তার বন্যা ও ভাঙন কবলিত এলাকা পরিদর্শন করে সরকারিভাবে সর্বোচ্চ সহায়তা প্রদানের আশ্বাস দেন।

কোলকোন্দ ইউপি চেয়ারম্যান সোহরাব আলী রাজু জানান, ইউনিয়নে ১৫ পরিবারের বাড়ি ঘর ভেঙে গেছে। লক্ষীটারি  ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল্লা আল হাদী জানান, এবারে তিস্তার ভাঙনে ওই ইউনিয়নের ৩শ’র অধিক পরিবার নদীগর্ভে সর্বশান্ত হয়েছেন।

রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মেহেদী হাসান জানান, ভাঙন রোধে জিও ব্যাগ স্থাপন করা হচ্ছে। উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ্ব রুহুল আমিন জানান, বন্যা ও ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোকে সরকারিভাবে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

ইউপি চেয়ারম্যানের কাছে ভাঙন কবলিত পরিবারগুলোর তালিকা চাওয়া হয়েছে। সরকারিভাবে আর্থিক সহায়তা পেলে তা দেওয়া হবে বলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানান হয়েছে। 

জেএম/রাতদিন