যেভাবে মুছে গেল জম্মু কাশ্মীরের জাতীয় পতাকা-সংবিধান: একটি টাইমলাইন

ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ নং অনুচ্ছেদের মাধ্যমে বিশেষ মর্যাদা পেতো জম্মু কাশ্মীর। ছিলো নিজস্ব সংবিধান, যা তারা পেয়েছিলো ১৯৫৬ সালে। ছিলো নিজের জাতীয় পতাকা।

আজ মঙ্গলবার, ০৬ আগষ্ট জম্মু-কাশ্মীর পুনর্গঠন বিলের প্রস্তাব রাজ্যসভার মতোই বিপুল ভোটে পাশ হয় লোকসভায়। এর ফলে প্রত্যাহার করা হয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ। বিলুপ্ত হয়ে হেল জম্মু কাশ্মীরে নিজস্ব পতাকা। এখন জম্মু কাশ্মীর শুধুই ভারতের দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল।

সেই ১৯৪৭ সাল থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ঘটনাবহুলতার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে বিশেষ মর্যাদা হারিয়ে রাজ্য থেকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত হল জম্মু কাশ্মীর, রাজ্য হয়ে গেল দ্বিখণ্ডিত। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ও আনন্দবাজার পত্রিকার সৌজন্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনাপ্রবাহের এই টাইমলাইন রাতদিননিউজের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো:

১৫ আগষ্ট ১৯৪৭:

১৯৪৭ সালের ১৫আগস্ট ভারত স্বাধীন হওয়ার সময়ে জম্মু কাশ্মীর ভারতের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। পাকিস্তানি সেনা অনুপ্রবেশের কারণে ওই বছর অক্টোবর মাসের ২৭ অক্টোবর রাজা হরি সিংহ কাশ্মীরের ভারতভুক্তির চুক্তি সই করেন।

মহারাজা হরি সিংহের নেতৃত্বেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গড়ে ওঠে কাশ্মীরে। শেখ আবদুল্লাহ কাশ্মীরের শাসক নিযুক্ত হন।

২৬ জানুয়ারি ১৯৫০:

ভারতের সংবিধান কার্যকরী হয়। সংবিধানের এক নম্বর ধারায় কাশ্মীরকে ভারতীয় রাজ্য হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। ৩৭০ ধারা অনুযায়ী বিশেষ সুবিধা পেতে শুরু করে কাশ্মীর। ১৯৫৬ সালে নতুন সংবিধান পায় কাশ্মীর, এই সংবিধানে কাশ্মীরকে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলা হয়।

৯ অগাস্ট, ১৯৫২:

জম্মু কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাকে গ্রেফতার করা হয়, তাঁর সরকারকে বরখাস্ত করা হল। তাঁর গ্রেফতারির নির্দেশে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় যে তিনি মন্ত্রিসভার আস্থা হারিয়েছেন। ১১ বছর জেলবন্দি রাখার পর তাঁর সঙ্গে সমঝোতা করেন কংগ্রেস।

১৯৫৭ সাল:

কাশ্মীরের প্রথম বিধানসভা ভোট অনুষ্ঠিত হয় এই বছর। তদানীন্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গোবিন্দ বল্লভ পন্থ কাশ্মীরে যান। বলেন, কাশ্মীর সন্দেহাতীত ভাবে ভারতের অংশ, গণভোট দরকার নেই।

১৯৬৫ সাল:

এ বছর মে মাসে কাশ্মীরের দু’টি সাংবিধানিক পদ প্রধানমন্ত্রী ও সদর-ই-রিয়াসত নিষ্ক্রিয় করে মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্যপাল-এই দুটি পদ কাশ্মীরে চালু করা হয়। এই বছর ভারত পাক যুদ্ধ বাধে।

১৯৭২ সাল:

ভারত পাকিস্তানের মধ্যে সিমলা চুক্তি হয়। নিয়ন্ত্রণরেখা না ভাঙার বিষয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় দুই দেশ। ১৯৭৫ সালে কাশ্মীরে বিধানসভার নির্বাচনে শেখ আবদুল্লা পুনঃনির্বাচিত হন।

২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৫:

ইন্দিরা গান্ধী- শেখ আবদুল্লা চুক্তি। জম্মু কাশ্মীর রাজ্য দেশের ৩৭০ ধারা দ্বারাই পরিচালিত হবে বলা হয় চুক্তিতে।

২৩ মার্চ ১৯৮৭:
এ সম্পর্কিত আরও খবর...

শুরু হয় জঙ্গিবাদের দিকে পথ চলার ঝোঁক। ১৯৮৪ সালে যে ফারুক আবদুল্লাকে বরখাস্ত করে কংগ্রেসের সমর্থনে তাঁরই আত্মীয়কে সে পদে বসানো হয়, ১৯৮৭ সালে সেই কংগ্রেসের সমর্থনে ফের মুখ্যমন্ত্রী হলেন সেই ফারুক আবদুল্লাই।

১৯৮৯ সাল:

ইতিহাসবিদ ভিক্টোরিয়া শোফিল্ড তাঁর বই কাশ্মীর ইন কনফ্লিক্টে লিখছেন এ বছরই শুরু হয় বিদ্রোহ। ঘনঘন ধর্মঘট শুরু হল, তৈরি হল বেশ কিছু সন্ত্রাসবাদী দল। মুফতি মহম্মদ সঈদ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই অপহৃত হন তাঁর মেয়ে রুবাইয়া।

১৯৯০ সাল:

এই সময়ে কাশ্মীরে হিংসা বাড়তে বাড়তে থাকে। জম্মু কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্টের নেতৃত্বে কাশ্মীরি যুবকরা স্বাধীন কাশ্মীরের দাবি জানাতে থাকেন। গোটা নব্বইয়ের দশকেই কাশ্মীরি পণ্ডিতরা ভিটেছাড়া হন সন্ত্রাসের জেরে। দিল্লিতে আশ্রয় নেন তারা।

সিআরপিএফের বাহিনী নিরস্ত্র জনতার উপর গুলি চালায়। ফেব্রুয়ারি মাসে রাজ্যপালের শাসন চালু হয় রাজ্যে।

১৯৯৫-২০০০ সাল:

১৯৯৫ সালে জম্মু কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্টকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিমা রাও বলেন ৩৭০ ধারা বলবতই থাকবে। পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী কাশ্মীর পরিদর্শন করেন। কার্গিলে ভারত-পাক যুদ্ধ বাধে। মাসুদ আজাহার-সহ তিন জঙ্গির মুক্তির দাবিতে বিমান অপহরণ হল এই বছরে।

এপ্রিল ২০০৩:

প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী জম্মু কাশ্মীর সফর সেরে এসে লোকসভায় ভাষণ দিলেন- যে ভাষণ তার পর থেকে বিভিন্নবার উদ্ধৃত হতে থাকবে। “আমি জোর দিয়ে বলতে চাই বন্দুক কোনও সমস্যার সমাধান করতে পারবে না, ভ্রাতৃত্ব তা পারবে। সমস্যার সমাধান হতে পারে যদি আমরা ইনসানিয়ত, জামহুরিয়ত ও কাশ্মীরিয়তের নীতিমালা কে আদর্শ ধরে অগ্রসর হই।”

২০০৪-২০১০ সাল:

মনমোহন জমানায় কাশ্মীরে পরিস্থিতি একটু ঠাণ্ডা ছিল। তবে এই সময়েই কাশ্মীরকে কেন্দ্র করেই বারবার লস্কর-ই-তইবা হামলা চালায় দেশের নানা প্রান্তে। অন্য দিকে কাশ্মীরে জঙ্গি হত্যাকে ঘিরে প্রতিবাদও সংগঠিত হয় বারবার।

২০১৩-২০১৮ সাল:

২০০১ সালে সংসদ ভবনে হামলার দায়ে আফজল গুরুকে ফাঁসি দেওয়া হল। এই সময়ে ‘পেলেট বনাম পাথর’ চলছে কাশ্মীরে ভারতীয় সেনা ও বিচ্ছিন্নতাবাদী কাশ্মীরিদের মধ্যে। ২০১৫ সালে কাশ্মীরে প্রথম সরকার গড়ে বিজেপি। বুরহান ওয়ানির মৃত্যুকে ঘিরে কাশ্মীর উত্তাল হয়। ২০১৮ সালে কাশ্মীরে বিজেপি ও পিডিপি-এর জোট ছিন্ন হয়। এই বছর কাশ্মীরে বিধানসভা ভেঙে রাষ্ট্রীয় শাসন জারি করা হয়।

১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯:

পুলওয়ামায় ৪০ জন সেনার মৃত্যু হয় মর্মান্তিক জঙ্গি হামলায়।

মে ২০১৯:

ক্ষমতায় ফেরে বিজেপি, ক্ষমতায় এসেই বিজেপি ঘোষণা করেছিল ৩৭০ ধারা তুলে দেওয়া হবে। ৪ আগস্ট, ২০১৯ মেহেবুবা মুফতি, ওমর আবদুল্লাকে গৃহবন্দি করা হয়। ৫ আগস্ট, ২০১৯ স্বরাষ্টমন্ত্রী অমিত শাহ রাজ্যসভায় ৩৭০ ধারা রদ করার প্রস্তাব পেশ করেন।

৬ আগষ্ট ২০১৯:

জম্মু-কাশ্মীর পুনর্গঠন বিলের প্রস্তাব রাজ্যসভার মতোই বিপুল ভোটে পাশ হয় লোকসভায়। প্রত্যাহার হয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ। জম্মু কাশ্মীর হয়ে যায় শুধুই ভারতের দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল।

জেএম/রাতদিন