শীতকালীন সবজি মুলা। এ মৌসুমের শুরুতে লালমনিরহাটের স্থানীয় খুচরা বাজারগুলোতে প্রতি কেজি মুলা বিক্রি হয়েছে অন্তত ৬০ থেকে ৮০ টাকা কেজি দরে। বর্তমানে খুচরা বাজরে বিক্রি হচ্ছে বাজার ভেদে সর্বোচ্চ পাঁচ থেকে সাত টাকা কেজি ধরে। আর কৃষকের মাঠে বর্তমানে পাইকারি দরে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে মাত্র দেড় থেকে দুই টাকা দরে।
এই বাস্তবতায় জেলার অনেক মুলা চাষি ক্ষেত থেকে মুলা তুলতে শ্রমিকের খরচ জোগাতে না পেরে গবাদিপশু দিয়ে নষ্ট করে ফেলছেন একরের পর একর ক্ষেত। অনেকে আবার ভুট্টা চাষের জন্য ট্রাক্টর দিয়ে চাষ করে মুলাক্ষেত নষ্ট করছেন।
কৃষকরা বলছেন, আগাম মুলা নষ্ট হয়েছে অতিবৃষ্টি-বন্যায়। দ্বিতীয় দফায় ফসলটি লাগানোর পর এখন তারা দাম না পেয়ে মারাতœক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে এসব তথ্য।
জেলা কৃষি বিভাগ জানায়, জেলার পাঁচ উপজেলায় এ মৌসুমে আলু ছাড়া বিভিন্ন শাকসবজি ছয় হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে মুলাও হয়েছে। তবে ঠিক কী পরিমাণ মুলা চলতি রবি মৌসুমে চাষাবাদ হয়েছে তা মৌসুম শেষে জানা যাবে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লালমনিরহাট সদর উপজেলার বড়বাড়ি ও মোগলহাট, আদিতমারীর সারপুকুর, কমলাবাড়ি, ভেলাবাড়ি ও দুর্গাপুর, কালীগঞ্জের গোড়ল ও চলবলা এবং পাটগ্রামের বাউরা, জগতবেড়, কুচলিবাড়ি ও জোংড়া ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে প্রচুর পরিমাণে সবজি চাষ হয়ে থাকে। এর মধ্যে মুলাও আছে। তবে জেলার সবচেয়ে বেশি পরিমাণ সবজি চাষ হয় আদিতমারী ও পাটগ্রাম উপজেলার বিভিন্ন এলাকায়। এবার উপজেলা দুটির বিস্তির্ণ এলাকায় চাষ হয়েছে অন্যান্য সবজির সাথে মুলা।
সরেজমিন: পাটগ্রামের বাউরা ইউনিয়ন। ওই ইউনিয়নের সীমান্তবর্তি গ্রাম নবীনগর(ডাঙ্গাটারি)। গতকাল রোববার, ২৯ নভেম্বও সাতসকালে সেখানে গিয়ে লক্ষ্য করা গেছে, লাভের আশায় চাষ করা মুলা এখন যেন কৃষকের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওই এলাকায় দেখা গেল, তরতাজা একটি বিশাল মুলাক্ষেত ট্রাক্টর দিয়ে চাষ করে নষ্ট করা হচ্ছে। এর কারণ জানতে চাইলে কৃষক রেজাউল করিম সবুজ বলেন, ‘প্রথমবার লাগানো মুলাক্ষেত নষ্ট হয়েছে বৃষ্টি-বন্যায়। দ্বিতীয়বার লাগানো মুলা যখন তরতাজা তখন আর বাজারে দামে নেই। এদিকে ভুট্টা লাগানোরও সময় চলে এসেছে। তাই বাধ্য হয়ে মুলাক্ষেত নষ্ট করে জমি তৈরি করছি’। ওই কৃষক জানান, তিনি প্রথম দফায় ৪৫ হাজার টাকা খরচ করে এবার ১০ বিঘা জমিতে মুলা লাগিয়েছিলেন কিন্তু তা নষ্ট হয়েছে বৃষ্টির কারণে। পরে আবারও একই জমিতে ৫০ হাজার টাকা খরচ করে মুলা লাগিয়েছিলেন।
শুধু তিনিই নন। নবীনগর(ডাঙ্গাটারি) এলাকার কৃষক আসাদুজামান ও তার ভাই হাবিবুর, আব্দুর রহিমসহ অনেকেরই একই অবস্থা। শুধু ওই গ্রামটি নয়, পাটগ্রামের সবজি চাষাবাদের জন্য বিখ্যাত অন্যান্য গ্রামেও মুলা নিয়ে চলছে অনেকটা একই অবস্থা।
কৃষকরা জানিয়েছেন, বতর্মানে ক্ষেতে প্রতি বস্তা(৬০ কেজি) মুলা বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকায়। সেই হিসাবে প্রতি কেজির মূল্য দাঁড়াচ্ছে দেড় থেকে দুই টাকা।
চাষি আসাদুজ্জামান বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা নিজেরাই জমি থেকে মুলা তুলে নিয়ে যাচ্ছে প্রতি বস্তা ৩০-৪০ টাকায়। এখন এই ফসল তোলার খরচই উঠছে না তাই যার ইচ্ছা সে ওই দামে নিজেই তুলে নিয়ে যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ পানির দামে বিক্রি না করে নিজের ফসল নিজেই নষ্ট করছে’।
আব্দুর রহিম বলেন, ‘প্রথমবার লাগানো মুলা হয়নি বৃষ্টির কারণে। বৃষ্টি শেষে সবাই একসাথে আবারো চাষ করায় একসাথেই ফসল উঠছে ফলে একেবারে দাম নেই। দাম আর বাড়ারও লক্ষন নেই’।
বিভিন্নভাবে মুলাক্ষেত নষ্ট করার কারণ সম্পর্কে কৃষকরা জানিয়েছেন, ভুট্টা চাষের সময় একেবারে চলে এসেছে তাই বসে না থেকে ক্ষেতেই মুলা নষ্ট করে ভুট্টাচাষের জন্য জমি তৈরি করা হচ্ছে।
পাটগ্রাম উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল গাফফার জানিয়েছেন, চলতি রবি মৌসুমে অন্তত ৬০ হেক্টর জমিতে মুলার চাষ হয়েছে ওই উপজেলায়। তবে বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাস্তবে এর চেয়েও অনেক বেশি পরিমাণ জমিতে চাষাবাদ হয়েছে মুলা।
এদিকে জেলার পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জসহ বিভিন্ন বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব বাজারে প্রতি কেজি মুলা বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ পাঁচ থেকে সাত টাকায়। কোনো কোনো হাটে আবার বেগুনের সাথে বিনামূল্যেও দেওয়া হচ্ছে মুলা।
দরপতনের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে জেলার মুলা চাষিরা- এ নিয়ে কথা হয় জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. শামীম আশরাফের সাথে। কৃষকদের উপরই দায় চাপিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রায় একই মৌসুমে এক সাথে সব চাষি এক একটি ফসল চাষাবাদ শুরু করলে বাজারে চাহিদা কমে গিয়ে দরপতন হয়। মুলার ক্ষেত্রে এবার সেটা হয়েছে। ফলে চাষের আগে বাজারের চাহিদা কৃষকদেরই নির্ধারণ করতে হবে’।
কৃষকদের পরামর্শ দিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘এবার যে ফসলের দাম পাওয়া গেল আগামি বছর সেরকম নাও গতে পারে। তাই বুঝেশুনে ও বাজারের চাহিদ দেখে যেকোনো ফসল চাষ করলে দাম পাওয়া যাবে।
এবি/রাতদিন