বিশেষ প্রতিনিধি, রংপুর থেকে:
ফাঁকি দিয়ে সরকারকে প্রায় পাঁচশত কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করছেন রংপুরের অসাধু বিড়ি মালিকরা। একশ্রেণীর শুল্ক কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে চলছে এই অনৈতিক কর্মকাণ্ড।
নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কম দামে বিক্রয় করে গত তিন বছরে প্রায় ১৫ শত কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছেন তারা।
রাতদিন নিউজ এর এক অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিড়ি শিল্প খ্যাত রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার হারাগাছ পৌর এলাকায় যেখানে একসময় নিবন্ধিত ২০ থেকে ২৫ টি বিড়ি ফ্যাক্টরি ছিল, ২০১৫ সালে অনলাইনে বিড়ি ফ্যাক্টরির লাইসেন্স দেয়া শুরু হলে সারাদেশে প্রায় এক হাজার বিড়ি ফ্যাক্টরির লাইসেন্স নেয়। যারমধ্যে হারাগাছ ও তার আশেপাশের এলাকায় রয়েছে প্রায় তিন শতাধিক বিড়ি ফ্যাক্টরি।
সরকার তামাকজাত পণ্যের উৎপাদনকে নিরুৎসাহিত করতে বিড়ি সিগারেট ও বিভিন্ন তামাকজাত পণ্যের ওপর প্রতিবছর ভ্যাট ও ট্যাক্স বাড়ালেও জাল ব্যান্ডরোল ব্যবহারকারী এসব ফ্যাক্টরী রয়েছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
বিগত সময়ে বিড়ি কারখানা স্থাপন, বিড়ি উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের লাইসেন্স পেতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ সক্ষমতা যাচাইয়ে সরেজমিনে তদন্ত করা হতো। কিন্তু অনলাইনে লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে তা শিথিল থাকায় অনেকেই ভূয়া তথ্য দিয়ে লাইসেন্স বাগিয়ে নেয়। ফলে যারা একসময় বিড়ি শ্রমিক ছিল, ফ্যাক্টরিতে কাজ করত কিংবা অন্য পেশায় ছিল এমন লোকজন বিড়ি ফ্যাক্টরির মালিক বনে গেছেন।
রংপুর জেলা বিড়ি শিল্প মালিক সমিতির তথ্যমতে, সরকারকে ভ্যাট, আয়কর ও স্বাস্থ্য ট্যাক্স বাবদ প্রতি প্যাকেটে ৭টাকা ৮৩ পয়সা ট্রেজারী চালানের মাধ্যমে প্রদান করে পোস্ট অফিস থেকে ব্যান্ডরোল উত্তোলন করতে হয়। প্রতি প্যাকেট বিড়ি ১৪ টাকায় বিক্রির রেট নির্ধারণ করেছে সরকার। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বাজারে ৫ থেকে ৬ টাকা প্যাকেট দামে বিক্রয় করা হচ্ছে বিড়ি। এমন প্রায় ৭০টি বিড়ির অস্তিত্ব বাজারে পাওয়া গেছে।
কিভাবে এত কম দামে বিক্রয় করছে এই রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, এ সমস্ত বিড়ি ফ্যাক্টরি মালিকরা ব্যান্ডরোল ব্যবহার করছেন না অর্থাৎ সরকারকে কোন ট্যাক্স দিচ্ছেন না । কিছুকিছু বিড়ির প্যাকেটের ব্যান্ডরোল এর লেভেল দেখা গেলেও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা গেছে এসমস্ত ব্যান্ডরোল নকল ও ব্যবহৃত পুরোনো।
তথ্য অনুসন্ধানে আরো যে বিষয় গুলো উঠে এসেছে তা হলো, যেহেতু দিনমজুর স্বল্পআয়ের গরীব মানুষরা বিড়ি খায়, তাই তাদের আকৃষ্ট করতে এই কম মূল্যে বিড়ি বাজারে ছাড়া হচ্ছে। এই সমস্ত নিম্নমূল্যের বিড়িগুলো স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ও নেশা জাতীয় বিভিন্ন দ্রব্য মেশানো হয় এমন অভিযোগ করেছেন হারাগাছ বিড়ি মজদুর ইউনিয়নের সভাপতি আমিন উদ্দিন বিএসসি।
এসমস্ত ফ্যাক্টরির মালিক বাড়িতে ছোট্ট আকারে কারখানা বসিয়ে শিশু ও নারীদের নামমাত্র পারিশ্রমিক দিয়ে বিড়ি তৈরি করছেন ফলে বিড়ি শ্রমিকদের জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
আরো জানা গেছে, হারাগাছে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে যেসব কোম্পানি বিড়ির ব্যবসা করছে তাদের মধ্যে রয়েছে শরীফ বিড়ি, আসাদ বিড়ি, স্টার আকিজ বিড়ি, তারেক বিড়ি, হামিদ বিড়ি, রাশেদ বিড়ি, পাখি বিড়ি, প্রাণ বিড়ি, সুলতান বিড়ি, বাংলা বিড়ি, আবুল বিড়ি সহ প্রায় দুই শতাধিক বিড়ি ফ্যাক্টরি।
বৃহস্পতিবার, রাতদিন নিউজ এর পক্ষ থেকে রংপুর বিভাগীয় কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের অতিরিক্ত কমিশনার আবদুল মান্নান সরদার এর সাথে কথা বলতে গেলে তিনি প্রথমে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। পরে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, তারাও জানতে পেরেছেন জাল ব্যান্ডরোল ব্যবহৃত বেশ কিছু বিড়ি বাজারজাত করা হচ্ছে এবং এ সমস্ত বিড়ির মান খুবই নিম্নমানের যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক।
ইতোমধ্যে রংপুর কাস্টমস এর পক্ষ থেকে বেশ কিছু অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে এবং হারাগাছ, কাউনিয়া, মাহিগঞ্জ থানায় শতাধিক মামলা করা হয়েছে। বেশ কয়েকটি ফ্যাক্টরিকে জরিমানা করা হয়েছে বলেও এ কাস্টমস কর্মকর্তা জানান।
রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (অপরাধ) কাজী মুত্তাকী ইবনু মিনান জানান, সারাদেশে দুর্নীতি বিরোধী যে কম্বাইন্ড অপারেশন শুরু হয়েছে সেই ধরনের অভিযান এব্যাপারে শুরু করা প্রয়োজন।
গত শুক্র ও শনিবার রংপুর জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মেহেদী হাসান এবং র্যাবের পৃথক অভিযানে হারাগাছের মেনাজ ও পদ্মা বিড়ি কারখানা থেকে ৬৫ হাজার ১২০ পিস নকল ব্যান্ডরোল আটক করা হয়েছে। যার প্রকৃত মূল্য প্রায় ৫ লাখ টাকা। এ সময় গ্রেপ্তার করা হয় হারাগাছের আবুল মখদুমের ছেলে এ এইচ এম মাহমুদ হাসান ওরফে ডনকে। এব্যাপারে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
শত শত কোটি টাকা ফাঁকি ও লুটপাটের জন্য হারাগাছে গড়ে উঠেছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এই সিন্ডকেটকে আটক করা গেলে সরকারের হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আয় বাড়বে বলে দাবি রংপুরের মানুষজনের।
এসকে/রাতদিন