সৈয়দপুরে মেধাবী দুই হরিজন সহোদর, পারি দিতে চায় তীরহারা ঢেউয়ের সাগর

নীলফামারীর সৈয়দপুরে পিতৃহীন সহোদর দুই ভাই বোন আশা রাণী বাসফোর এবং আশিক বাসফোর কৃষ্ণার উচ্চ শিক্ষায় চরম অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। লেখাপড়ার ব্যয়ভার মেটানো নিয়ে আর্থিক সংকটে পড়েছে হরিজন সম্প্রদায়ের দুই শিক্ষার্থী। তবুও অদম্য আকাঙ্খা আর প্রবল ইচ্ছায় পারি দিতে চায় অনতিক্রম্য সকল বাঁধার দেয়াল।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সৈয়দপুর শহরের মুন্সিপাড়া হরিজন (দলিত) পল্লীর স্বর্গীয় হীরা লাল বাসফোর। তিনি ২০১২ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরলোক গমন করেন। ইহলোকে রেখে যান স্ত্রী মানতী রাণী বাসফোর, মেয়ে আশা রাণী বাসফোর এবং পুত্র আশিক বাসফোর কৃষ্ণাকে। হীরা লাল বাসফোররা বংশ পরস্পরায় পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজে নিয়োজিত। কিন্তু স্বর্গীয় হীরা লাল তাঁর দুই ছেলেমেয়েকে তাদের আদি পেশায় জড়াতে দেননি। তিনি ছেলে মেয়েকে শিক্ষিত করার মানসে স্কুলে ভর্তি করান।

অনেক ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে আজ তাঁর ছেলে মেয়েরা লেখাপড়া করছে। তাঁর বড় বোন আশা রাণী বাসফোর। সে তাদের হরিজন পল্লীর পাশের সৈয়দপুর ইসলামিয়া কিন্ডারগার্টেন থেকে প্রাথমিকের গন্ডি পেরিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে উর্ত্তীণ হয়। এরপর ভর্তি হয় সৈয়দপুর আদর্শ বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজে ষষ্ঠ শ্রেণীতে। সেখান থেকে ২০১৬ সাল এসএসসি এবং ২০১৮ সালে এইচএসসি পাশ করে। সে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষায়পেয়েছে যথাক্রমে জিপিএ-৪.৫০ এবং জিপিএ – ৩।

দলিত সম্প্রদায়ের মেয়ে আশা রানী বাসফোর লেখাপড়ার পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রমেও বেশ পারদর্শী। বিদ্যালয় ও কলেজে অধ্যয়নকালে গার্লস গাইড দলের সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত ছিল সে। সেই সঙ্গে মেয়েদের হ্যান্ডবল, ভলিবল, ক্রিকেট ও ব্যাটমিন্টন খেলায় অংশ নিয়ে অনেক পুরস্কার জিতেছে। শুধু লেখাপড়া কিংবা খেলাধুলায় নয়; সঙ্গীত ও নৃত্যতেও সমান পারদর্শী সে। নিয়মিত লেখাপড়ায় সঙ্গে সঙ্গে সহশিক্ষা কার্যক্রমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এবং প্রতিষ্ঠানের হয়ে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে অংশ নিয়ে ছিনিয়ে আনে অনেক মেডেল, পুরস্কার, সনদপত্র। যা এখন তাদের হরিজন পল্লীর ঘরে শোভা পাচ্ছে।

পিতৃহীন আশা রাণী তাঁর পরিবারের শত অভাব অনটনের মধ্যেও লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে সে রংপুর রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিষয়ে অনার্স প্রথম বর্ষের অধ্যয়নরত। স্কুল -কলেজে অধ্যয়নকালে তাদের হরিজন পল্লী থেকে এক বেলা খেয়ে না খেয়ে গিয়ে লেখাপড়া করেছে সে। কিন্তু বর্তমানে উচ্চ শিক্ষার কারণে তাকে থাকতে হচ্ছে রংপুরে। অবস্থান করতে হচ্ছে শহরের বেসরকারি ছাত্রীনিবাসে। এতে তাকে ছাত্রীনিবাসের সিট ভাড়া, প্রতিদিনের তিন বেলা খাওয়া-দাওয়া এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ার খরচ মেটাতে হচ্ছে।

বাবার অবর্তমানে মা মানতী রাণী বাসফোরই তাঁর একমাত্র ভরসা। মা মানতী রাণী রাসফোর নেসকো ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানির সৈয়দপুর অফিসে একজন ঝাড়–দার। বেতন যৎসামান্য। বর্তমানে তাঁর আয় দিয়ে চলছে তাদের তিন সদস্যের পরিবার। একদিকে, আশা রাণী বাসফোরের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হওয়ার থেকে তাঁর লেখাপড়ার খরচ কয়েকগুন বেড়ে গেছে।

অপরদিকে, তাঁর ছোট ভাই আশিক বাসফোর কৃষ্ণা এবারের এসএসসি পাশ করেছে। শহরের শহীদ জিয়া শিশু নিকেতন থেকে মানবিক বিভাগে উত্তীর্ণ হয় সে। তাকে এখন কলেজে ভর্তি হতে হবে। এতে অনেক টাকা পয়সা দরকার। তাই বতর্মানে দুই ভাইবোনের লেখাপড়ার আর্থিক সংকট পড়েছে তাঁর পরিবার। তাই চরম অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে তাদের উচ্চ শিক্ষা। ছেলেমেয়ের লেখাপড়া ব্যয় মেটানো নিয়ে বাসফোর ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তাঁর মা মানতী রাণী।

তিনি জানান, তাদের বাবা নেই। তাদের বাবার স্বপ্ন ছিল ছেলে মেয়েকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলবেন। তাই তাঁর স্বপ্ন পুরণে আমি দিনরাত হাঁড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে তাদের লেখাপড়া করাচ্ছি।

সম্প্রতি সৈয়দপুর আদর্শ বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজে বসে এ প্রতিনিধি’র কথা হয় আশা রাণী ও আশিক বাসফোরের সঙ্গে। আশা রাণী উচ্চ শিক্ষা শেষে ভবিষ্যতে প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। আর তাঁর ছোট ভাই আশিক বাসফোর লেখাপড়া সম্পন্ন করে হতে চান একজন আদর্শবান পুলিশ অফিসার। বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে চান তারা দুইজনেই। মায়ের মুখে হাসি ফুটাতে চান। কিন্তু বর্তমানে পরিবারের আর্থিক সংকট কেটে লেখাপড়া করে তারা স্বর্গীয় বাবার স্বপ্ন ও মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে কী আদৌ সক্ষম হবে ?

সৈয়দপুর আদর্শ বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মো. হাবিবুর রহমান হাবি বলেন, আশা রাণী বাসফোর লেখাপড়ায় খুবই আগ্রহী। সে অত্যন্ত মেধাবী, বিনয়ীও। ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে সে আমার প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করে এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হয়েছে। আমার প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-শিক্ষিকা তার লেখাপড়ায় ব্যাপক উৎসাহ যুগিয়েছেন। আমরা প্রতিষ্ঠান থেকে তার পড়াশুনায় সাধ্যমতো সহযোগিতা দেওয়ার চেষ্টা করেছি।

অধ্যক্ষও আত্মবিশ্বাসের সাথে জানালেন, উচ্চ শিক্ষা শেষে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে আশা রাণী বাসফোর। আর তাঁর উচ্চ শিক্ষায় সমাজের বিত্তশালীদের আর্থিক সহায়তার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

জেএম/রাতদিন