জবর লড়াই লাঙল-ধানের শীষে

ছবি : সংগৃহীত
0

লালমনিরহাট-৩

ছিমছাম, শান্ত এক জেলা শহর লালমনিরহাট। সেই নিরিবিলি আবহ এখন আর নেই। আসন্ন নির্বাচন উপলক্ষে প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণা, বিকট শব্দের মাইকিং, খণ্ড খণ্ড মিছিল শহরটিকে করেছে উৎসবমুখর। উত্তর প্রান্তের সীমান্তঘেঁষা এ শহর এবং আশপাশের কিছু ইউনিয়ন ও গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে দুই ‘হেভিওয়েট’ প্রার্থীর পক্ষে ব্যাপক প্রচারণা। চায়ের দোকানে সাধারণ মানুষও মেতে উঠেছে নির্বাচনী তর্ক-বিতর্কে। সাধারণ ভোটাররা বলছে, এবার লাঙল ও ধানের শীষের জবর লড়াই হবে।

লালমনিরহাট সদরের পৌরসভা ও ৯টি ইউনিয়ন নিয়ে লালমনিরহাট-৩ আসন। মহাজোটের পক্ষে এ আসনে লাঙল প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী জি এম কাদের। ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে ধানের শীষে লড়ছেন আরেক সাবেক মন্ত্রী বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও লালমনিরহাট জেলা বিএনপির সভাপতি আসাদুল হাবিব দুলু। দুই প্রার্থীরই অতীতে একে অন্যের বিরুদ্ধে রয়েছে হার-জিতের রেকর্ড। অতীতে জাতীয় পার্টির ঘাঁটি হলেও এ আসনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিরও রয়েছে শক্তিশালী অবস্থান।

লালমনিরহাট পৌরসভা অঞ্চল পেরিয়ে সীমান্তঘেঁষা ইউনিয়ন মোগলহাট। ঘুরে দেখা যায়, কাদের ও দুলু দুই প্রার্থীর পোস্টারে সব ছেয়ে গেছে। সেখানে ধরলা নদীর তীরের এক বাজারে এক চায়ের দোকানে কথা হয় ফুলগাছ গ্রামের বাসিন্দা রুবেল হোসেনের সঙ্গে। নির্বাচন ও দুই প্রার্থী সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “দুইজনই মানুষ ভালো। তবে কাদের স্যার তো ‘বসন্তের কোকিল’। এলাকায় তিনি একদমই আসেন না। নির্বাচনের সময় শুধু আসেন। দুলু ভাইকে সব সময়ই কাছে পাওয়া যায়। সাধারণ মানুষের কাছে তিনি খুবই জনপ্রিয়।”

লালমনিরহাট শহরে এক পাশে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে বিশাল এলাকা নিয়ে স্থাপিত এয়ারপোর্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কৌশলগত কারণে এ এয়ারপোর্ট নির্মাণ করেছিল তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার। পরে কিছুদিন চালু থাকলেও তা পরিত্যক্ত হয়ে যায়। লালমনিরহাটবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি ছিল, জি এম কাদের এই এয়ারপোর্ট চালু করতে কার্যকর ভূমিকা নেবেন। তিনি যখন বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন, তখন আশায় বুক বেঁধেছিল এ অঞ্চলের মানুষ। লালমনিরহাট শহরের বাসিন্দারা অভিযোগ করে বলে, ‘কাদের এ বিষয়ে উদ্যোগ নিলেও শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন করতে পারেননি। এ ছাড়া তিনি এলাকার জন্য দৃশ্যমান তেমন কোনো উন্নয়ন করেননি।’ জি এম কাদেরের প্রতি অনেকের অভিমান থাকলেও তাঁকে অনেকেই সৎ ও ‘ক্লিন ইমেজের’ মানুষ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

লালমনিরহাট-৩ আসন থেকে জি এম কাদের দুইবার এমপি নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালে এ আসন থেকে নির্বাচিত হয়ে তিনি বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, পরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দিলেও শেষ পর্যন্ত দলীয় সিদ্ধান্তের কারণে নির্বাচনের মাঠে না থাকায় সামান্য কিছু ভোট পেয়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর কাছে হেরে যান। তখন আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত হন বর্তমান সংসদ সদস্য আবু সালেহ মো. সাঈদ দুলাল। তিনি এবার মনোনয়ন প্রত্যাশা করলেও মহাজোটের একক প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পান জাতীয় পার্টির জি এম কাদের।

লালমনিরহাট পৌরসভা অঞ্চলের শেষ মাথায় বানভাসা বাজার। বাজারে মাছ বিক্রি করতে এসেছিলেন খুটামারা গ্রামের বাসিন্দা রজব আলী। নির্বাচনে কাকে ভোট দেবেন জানতে চাইলে তিনি হেসে বলেন, ‘কাক্ ভোট দেমো, তাক কবার নাও। কিন্তু ভোট দিবার যাইম।’ কথা প্রসঙ্গে তিনি জানান, কাদের শুধু নির্বাচনের সময় আসেন। এলাকার মানুষ সুখে-দুঃখে তাঁকে কাছে পায় না। কিন্তু দুলুকে ডাকলেই পাওয়া যায়। সবাইকে তিনি বুকে টেনে নিতে পারেন।

হারাটি, খুনিয়াগাছ, মোগলহাট, মহেন্দ্রনগর ইউনিয়ন ঘুরে স্থানীয় ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুই প্রার্থীরই রয়েছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা। জি এম কাদেরকে কেউ কেউ ‘বসন্তের কোকিল’ বললেও এ অভিযোগ অস্বীকার করেন আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির স্থানীয় নেতারা। তাঁরা বলছেন, বিএনপি ও জামায়াতের লোকজনই এ ধরনের কথা প্রচার করছে। জি এম কাদের প্রায়ই এলাকায় আসেন, এলাকার জন্য কাজ করেন।

বৃহস্পতিবার কুলাঘাট ইউনিয়নে বিভিন্ন গ্রামে জনসংযোগ ও জনসভায় অংশ নেন জি এম কাদের। প্রচারণার এক ফাঁকে তিনি বলেন, ‘আমার বড় ভাই এরশাদ এ অঞ্চলের সন্তান, আমিও এ অঞ্চলের সন্তান। এরশাদ লালমনিরহাটকে জেলায় উন্নীতকরণসহ নানা ধরনের অবকাঠামো নির্মাণে কাজ করেছেন। অপরদিকে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে শেখ হাসিনা আমাকে মনোনীত করেছেন। তাই আমি মনে করি, এই আসনে মহাজোটের প্রতীক লাঙল বিপুল ভোটে বিজয়ী হবে।’ তিনি বিজয়ী হলে এ আসনে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি, অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, বিমানবন্দর ও মোগলহাট স্থলবন্দর পুনরায় চালুসহ নানা উন্নয়নমূলক কাজ করবেন বলে আশ্বাস দেন।

লালমনিরহাট-৩ আসনে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে ৩১ হাজার ২০৫ ভোট পেয়ে লাঙল প্রতীকে বিজয়ী হন জাতীয় পার্টির রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ। সে সময় ২৫ হাজার ৩৫৬ ভোট পেয়ে তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আওয়ামী লীগের আবুল হোসেন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ৩৯ হাজার ৭৫৫ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন জাতীয় পার্টির জি এম কাদের। ওই নির্বাচনে ৩৬ হাজার ৮৮১ ভোট পেয়ে তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছিলেন বিএনপির আসাদুল হাবিব দুলু।

২০০১ সালের নির্বাচনে ৬৩ হাজার ৩৫৯ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন আসাদুল হাবিব দুলু। এই নির্বাচনে ৪২ হাজার ৯১২ ভোট পেয়ে হেরে যান আওয়ামী লীগের আবু সালেহ মো. সাঈদ দুলাল। তখন ভোটের হিসাবে তৃতীয় হয়েছিলেন জাতীয় পার্টির জি এম কাদের। ২০০৮ সালের নির্বাচনে মহাজোটের একক প্রার্থী কাদের ৯৮ হাজার ২১৭ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। আর ৭৪ হাজার ৬৫৩ ভোট পেয়ে হেরে যান বিএনপির আসাদুল হাবিব দুলু।

নির্বাচনী ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির ভোট এক বাক্সে থাকায় এবার এগিয়ে থাকবেন জি এম কাদের। লালমনিরহাট জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মতিয়ার রহমান বলেন, ‘দল হিসেবে লালমনিরহাট-৩ আসনে জাতীয় পার্টির সেই রকম অবস্থান না থাকলেও তাদের যারা আছে তাদের নিয়ে আমাদের নেতাকর্মীরা জোরেশোরেই নেমেছে ভোটের মাঠে। আর আমরা বিপুল ভোটে জিতব বলে শতভাগ আশাবাদী।’

ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা দুলু জেলায় দলের নেতৃত্বও দিচ্ছেন। লালমনিরহাটে বিএনপিকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করান তিনিই। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো নির্বাচিত এমপি দুলু পরে খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়ে এলাকায় উন্নয়ন কার্যক্রম চালান। কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে তিনি দলকেও সুসংগঠিত করেন।

গতকাল দিনভর লালমনিরহাট পৌরসভা অঞ্চলে জনসংযোগ করেন দুলু। প্রচারণার এক ফাঁকে বিএনপির এই প্রার্থী বলেন, ‘আমাদের কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে অনেককে হুমকিও দিচ্ছে সরকারদলীয় লোকজন। এর পরও আমরা মানুষের বিপুল সাড়া পাচ্ছি। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে আমরা বিজয়ী হব।

মতামত দিন