‘অমপুরি’ ভাওয়াইয়া, ভাওয়াইয়ার রংপুর

প্রাচীন শাস্ত্র ও পুরাণে বর্ণিত আছে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা মহাদেবের নিকট প্রথম সঙ্গীত শিক্ষা গ্রহণ করে ভরত, নারদ, রম্ভা, হুহু ও তম্বুরু এই পাঁচ শিষ্যকে শিক্ষা দেন। তাদের মধ্যে ভরত মুনির দ্বারা পৃথিবীতে সঙ্গীত প্রচারিত হয়।

তবে উত্তরজনপদের স্বকীয়তার পরিচয় বহনকারী সংগীতের ধারা ‘ভাওয়াইয়া’ কিন্তু সেভাবে উৎপত্তি লাভ করেনি।

বাংলাদেশের প্রচলিত লোক সঙ্গীতগুলোর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা হচ্ছে ভাওয়াইয়া। এটি বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের গান হিসেবে পরিচিত। উত্তরবঙ্গের কোচ রাজবংশীয়রা ভাওয়াইয়া গানের স্রষ্টা। ভারতের কোচবিহার জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং জেলার সমভূমি অঞ্চল, পশ্চিম দিনাজপুর জেলার উত্তরাংশ অসমের গোয়ালপাড়া ও ধুবড়ি জেলা এবং বাংলাদেশের রংপুর লালমনির হাট, কুড়িগ্রাম নীলফামারী, গাইবান্ধা ও দিনাজপুর জেলার কিছু অংশে এই গানের বিস্তৃতি।

১৯০৪ সালে প্রকাশিত ইউরোপের লোকসঙ্গীত গবেষক এবং সংগ্রাহক গ্রীয়ারসন কর্তৃক প্রকাশিত ‘Linguistic Survey of India’ গ্রন্থে সর্বপ্রথম ভাওয়াইয়া নাম লিখিত আকারে পাওয়া যায়। কিভাবে এবং কি কারণে এই গানের নাম ভাওয়াইয়া হয়েছে সে সম্পর্কে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন মত।

 ভাওয়াইয়া নামকরণের ক্ষেত্রে বহুল প্রচলিত মতগুলো এরকম:

এই অঞ্চলের উপর দিয়ে বয়ে গেছে ধরলা, তিস্তা, দুধকুমার, কালজানি, ক্ষীরখ্যাপা, তোরষা প্রভৃতি নদী। খরস্রোতা এসব নদীর প্রতিনিয়ত ভাঙনের ফলে সর্বদাই এদের গতি পরিবর্তন হয়। আর গতি পরিবর্তনের ফলে জলকাদা পূর্ণ এসব নদীর তীর ভূমিতে মধুয়া কাশিয়া জন্মায়। এরূপ স্থানকে বলা হয় ভাওয়া। যেখানে মইষালরা মহিষ চড়াত এবং গান গাইত। ভাওয়া অঞ্চল থেকে মইষালদের কণ্ঠ হতে এই গান ভেসে আসত বলে একে ভাওয়াইয়া নামে অভিহিত করা হয়।

আবার, ভাওয়াইয়ার একনিষ্ঠ সুর সাধক প্রায়ত সুরেন রায় বসুনিয়ার অভিমত থেকে জানা যায়, ‘ভাবপূর্ণ’ যে গীত মানুষকে ভাব বিহ্বল করে দেয় তাই ভাওয়াইয়া তিনি দেখিয়েছেন। ভাবভাও+ইয়া=ভাওয়াইয়া। এর বুৎপত্তিগত অর্থ; যেভাবে অর্থাৎ ভাওয়াইয়া হচ্ছে ভাবুকের গান।

বাংলার লোক সঙ্গীতের সুর সম্রাট ভাওয়াইয়া গায়ক আব্বাস উদ্দিনের মতে, ভাওয়াইয়া উত্তরবঙ্গ তথা কোচবিহারের নিজস্ব সম্পদ। উদাস হওয়ার মতো এই সুরের গতি তাই তার নাম ভাওয়াইয়া।

লালমনিরহাটের কালিগঞ্জ উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রয়াত ধর্ম নারায়ণ সরকার ভক্তিশাস্ত্রীর মতে, ভাওয়াইয়া শব্দের অর্থ ভাবোত্থিত। এখানে দন্তৌষ্ট বর্ণ অন্তস্থ ‘ব’ এর উচ্চারণ কিছুটা ‘ও’ এর ন্যায় হয়। যেমন দেব শব্দের উচ্চারণ হয় দেও। তেমনি ভাব শব্দ থেকে ভাও এবং তা থেকে ভাওয়াইয়া শব্দ ভাওয়াইয়া পদে নিষ্পন্ন হয়েছে।

লালন পুরস্কার প্রাপ্ত ভাওয়াইয়া শিল্পী প্যারিমোহন দাস এবং শাস্ত্রীয় এবং লোকসঙ্গীতের সাধক এবং কুমার নিধিনারায়ণও এই মতের সমর্থক ছিলেন।

উত্তরবঙ্গের আর একজন ভাওয়াইয়া দরদী মানুষ অধ্যাপক হিতেন নাগ উপরের মতগুলোর গ্রহণযোগ্যতা সমন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন, উত্তরবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে ‘ইয়া’ প্রত্যয় যোগে ব্যক্তির পেশা কর্ম ও বৃত্তিগত পরিচয় দেবার রীতিটা বেশ প্রচলিত। যেমন, যে খায় তাকে বলে খাওয়াইয়া, যে নেয় তাকে বলে নেওয়াইয়া। উপরের যুক্তিটা মেনে নিলে ভাওয়াইয়া শব্দটিও একই নাম বাচক। যার মধ্যে ব্যক্তির কর্মটি লুকিয়ে আছে। ভাওয়াইয়া গবেষক ও শিল্পী সুখবিলাস বর্মার মতেও ভাব বা ভাও থেকেই ভাওয়াইয়ার জন্ম।

ভাওয়াইয়ার বৈশিষ্ট্য:

ভাওয়াইয়া গানের আর একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে এতে বাদ্য যন্ত্রের সাবলিত এবং মার্জিত প্রয়োগ। বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে ভাওয়াইয়া গানে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে দোতারা। এর উচ্চমাত্রার টান গানের বিরহ ব্যথাকে যেন শতগুণে বাড়িয়ে দেয়। দোতারা ছাড়াও বাঁশি, খোল, মন্দিরা, খমক এবং ঢোল ভাওয়াইয়া গানে ব্যবহৃত হয়।

ভাওয়াইয়ার প্রকারভেদ:

ভাওয়াইয়া গানের বিশেষজ্ঞ হরিশচন্দ্র পাল ভাওয়াইয়া গানকে পাঁচ ভাগে ভাগ করেছেন।

এক. চিতান ভাওয়াইয়া: এই গান বিচ্ছেদ বেদনায় ভেঙ্গে পরার গান। সাধারণত এই গান অস্থায়ীতে উচ্চগ্রাম থেকে আরম্ভ হয়ে ক্রমেই নিম্ন গ্রামের দিকে যায়।

দুই. ক্ষীরোল ভাওয়াইয়া: এই শ্রেণীর গানে দোতারা বাজানোর একটি বিশেষ ধরন আছে। এভাবে দোতারা বাজানোর পদ্ধতিতে বলা হয় ‘ক্ষীরোল ডাং’। বিরহের প্রতীক এই গান নিম্নগ্রামে আরম্ভ হয়ে উচ্চগ্রামে যায়।

তিন. দরিয়া ও দীঘলনাসা ভাওয়াইয়া: উভয় গানই দীর্ঘ প্রসারিত দম সাপেক্ষ সুর যেন স্রোতের টানে বিলিয়ে দেবার সুর।

চার. গড়ান ভাওয়াইয়া: এই গানের সুর এতই করুণ হয় বিরহ বেদনা কাতর নারী যেন ধুলায় গড়াগড়ি যায়।

পাঁচ. মইষালী ভাওয়াইয়া: এই ভাওয়াইয়া অন্যান্য ভাওয়াইয়ার মতোই কিন্তু চাল ভিন্ন ধরনের। এই গান গাইবার সময় মনে হয় যেন গায়ক কোন কিছুর উপর সোয়ার হয়ে চলছে। চলার ছন্দ গানের ছন্দে প্রকাশ পায়।

শেষকথা:

উৎপত্তি যেভাবেই হোক আর বৈশিষ্ট্য যাই থাকুক ভাওয়াইয়াই একমাত্র সংগীতের ধারা যাতে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনবোধ, বৃত্তি ও সমাজব্যবস্থার পরিচায়ক। সেই জন্যই বোধ হয় ইউরোপে একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে যে, একটি দেশের লোকসঙ্গীত জানলে সেখানে না গিয়েও যেখানকার অনেক কিছুই জানা সম্ভব।

জেএম/রাতদিন