প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এসেছিলেন বলেই মার্কিন সংবাদ মাধ্যমের বাড়তি নজর ছিল দিল্লির ওপর। ফলে চলতি সন্ত্রাস, সঙ্ঘর্ষের ঘটনা উঠে এসেছে আমেরিকার প্রতিটি বড় খবরের কাগজ এবং টিভি চ্যানেলে। যা পড়ে, দেখে, নিন্দায় সরব হয়েছেন মার্কিন রাজনীতিকরাও। মনে করিয়ে দিয়েছেন, সারা বিশ্ব কিন্তু নজর রাখছে।
তীব্র কটাক্ষ করেছে ‘নিউ ইয়র্ক টাইম্স’ পত্রিকা। ট্রাম্পের সফর চলাকালীন প্রকাশিত প্রথম প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং প্রধানমন্ত্রী মোদি দিল্লির একদিকে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ এবং বৈঠকে ব্যস্ত ছিলেন। মি: মোদির ‘হিন্দু–ফার্স্ট’ নীতি যে দিল্লির আরেক অংশে দাঙ্গা এবং গোষ্ঠী সঙ্ঘর্ষ হয়ে ফেটে পড়েছে, তার কোনও প্রভাব ওঁদের কর্মসূচিতে পড়েনি।’ এই লেখাটির শিরোনাম ছিল— দিল্লির রাজপথ, হিন্দু–মুসলমানের যুদ্ধক্ষেত্র। সঙ্গে এক মুসলিমকে ঘিরে ধরে দলবেঁধে লাঠিপেটা করার কুখ্যাত হয়ে যাওয়া ছবিটি।
নিউ ইয়র্ক টাইম্সের পরের লেখা আরও আক্রমণাত্মক। ট্রাম্প এবং মোদির হাসিমুখে হাত মেলানোর ছবি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘হায়দরাবাদ হাউসের সাজানো বাগানে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং প্রধানমন্ত্রী মোদি তাঁদের বন্ধুত্বের উদযাপন করলেন। বৈচিত্র সত্ত্বেও এক আধুনিক, ঐক্যবদ্ধ ভারতের কথা আলোচনা করলেন। তখন শহরের আরেক অংশে মোদির সাম্প্রদায়িক নীতি নিয়ে গণবিক্ষোভ গোটা একটি এলাকার জনজীবন বিপন্ন করে তুলেছে। বাড়িয়ে তুলেছে ধর্মীয় বিভাজন, রেখে গেছে এক সার মৃতদেহ।
দিল্লিতে মঙ্গলবার যা ঘটল, তা আরও একবার প্রমাণ করল সুরক্ষার দুর্গের ভেতরে বসে বিশ্বনেতারা যা বলেন, বা ভাবেন, তার সঙ্গে বাস্তব পরিস্থিতির কত তফাত। প্রেসিডেন্টের সফরের জাঁকজমকের থেকে সামান্য দূরেই একদল হিন্দু লোহার রড হাতে তাদের মুসলিম পড়শিদের তাড়া করছে। রাস্তাভরে ছড়িয়ে আছে ভাঙা ইটের টুকরো।
দৈনিক ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ সরাসরি আক্রমণ করেছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে। এক প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে, ‘ধর্মীয় স্বাধীনতার সুরক্ষায় মোদির প্রচুর পরিশ্রমের প্রশংসা করেছেন ট্রাম্প, কিন্তু সিএএ নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি’। ট্রাম্প প্রায়ই বলেন, মোদি তাঁর ‘ভাল বন্ধু’।
সেই বন্ধুকৃত্য করতে গিয়ে মোদি, বা তঁার সরকারের সমালোচনা হতে পারে, এমন কোনও ব্যাপারে ট্রাম্প মন্তব্য করতে চাননি। অথচ গত কয়েক মাসে মোদি অনেক পদক্ষেপ করেছেন, যা তাঁর হিন্দু আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কর্মসূচিকে সফল করবে।
রীতিমতো ব্যঙ্গ করেছে বিখ্যাত সংবাদ সাপ্তাহিক ‘নিউজ উইক’। বলেছে, আমেদাবাদের ‘নমস্তে ট্রাম্প’ অনুষ্ঠানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট যখন শান্তির বাণী শোনাচ্ছেন, তখন সম্পূর্ণ উল্টো ঘটনা ঘটছে দিল্লির রাজপথে। লেখাটিতে সিএএ নিয়ে সরাসরি বলা হয়েছে, মুসলিমদের ভারতে ঢোকা বন্ধ করা এবং ভারতের মুসলিম নাগরিকদের আরও বেশি কোণঠাসা করাই এই আইনি সংশোধনীর উদ্দেশ্য।
‘ভাইস’ নামে আর এক জনপ্রিয় সংবাদ মাধ্যম রোম নগরী পুড়ে যাওয়ার সময় সম্রাট নিরো’র বেহালা বাজানোর পরোক্ষ তুলনা টেনে শিরোনামে লিখেছে- দিল্লি যখন জ্বলছে, মোদি তখন অতিথি প্রেসিডেন্টের সম্মানে পার্টি দিচ্ছেন!
মার্কিন টিভিতে দিল্লি প্রসংগ
গুজরাট দাঙ্গার প্রসঙ্গ তুলে এনেছে মার্কিন টিভি চ্যানেল এনবিসি। মনে করিয়ে দিয়েছে ২০০২ গুজরাট দাঙ্গা এবং তখন মুখ্যমন্ত্রী মোদির ভূমিকা। যার জেরে অনেক বছর মোদির আমেরিকায় যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। ‘এখন মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর যে বহুধর্মীয় সংস্কৃতি ভারতের ভিত্তি, তার ওপর ভয়ঙ্কর আঘাত করে যাচ্ছেন।’ এনবিসি এই খবর দেওয়ার সময় দেখিয়েছে দিল্লির চলতি সঙ্ঘর্ষ, সন্ত্রাসের ভিডিও ফুটেজ। পাশাপাশি দেখানো হয়েছে ট্রাম্পের সম্মানে সরকারি অনুষ্ঠানের জাঁকজমক, দুই নেতার সহাস্য ঘোরাফেরা। শেষে প্রশ্ন রেখেছে, এর পরেও ট্রাম্প কী করে ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রশ্নে মোদির প্রশংসা করে এলেন?
বিশ্বের অন্যান্য গণমাধ্যম:
শুধু মার্কিন সংবাদ মাধ্যমই নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশের প্রথম সারির খবরের কাগজ, পত্রিকা এবং টিভি চ্যানেলেও একই সমালোচনার সুর ধরা পড়েছে। ব্রিটিশ দৈনিক ‘দ্য গার্ডিয়ান’ লিখেছে, মারাত্মক বিক্ষোভে চাপা পড়ল ট্রাম্পের দিল্লি সফর।
জার্মান সংবাদ সাপ্তাহিক ‘ডের স্পিগেল’র শিরোনাম- বাইরে দেখনদারি, বিক্ষুব্ধ অন্তর! ফরাসি সংবাদ সংস্থা এএফপি লিখেছে- অতিথি মার্কিন প্রেসিডেন্টের জন্যে লাল কার্পেট বিছিয়েছে ভারত। কিন্তু যিনি আতিথেয়তা দেখাচ্ছেন, ভারতে চলতি ভয়ঙ্কর অশান্তির জন্য মূল অভিযুক্ত তিনিই।
মার্কিন রাজনীতিকদের চোখে:
মঙ্গলবার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প স্বদেশে ফেরার পর মার্কিন রাজনীতিকদেরও প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। মার্কিন কংগ্রেসের সদস্য, ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রমীলা জয়পাল ছেড়ে আসা স্বদেশে ‘ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার ভয়ঙ্কর উত্থান’ প্রসঙ্গে টুইট করেছেন- ‘গণতন্ত্রে বিভেদ এবং বৈষম্যকে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়। এমন কোনও আইন আনা উচিত নয়, যা ধর্মীয় স্বাধীনতা খর্ব করে।’ সবশেষে জয়পাল জুড়ে দিয়েছেন- ওয়র্ল্ড ইজ ওয়াচিং। বিশ্ব কিন্তু নজর রাখছে।
আরেক কংগ্রেস সদস্য অ্যালান লোয়েনথাল মন্তব্য করেছেন- ‘ভারতের চলতি সন্ত্রাস আসলে নৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতা। ভারতে মানবাধিকার যে সঙ্কটের মুখোমুখি, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেই হবে।’
মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডেমোক্র্যাট দলের সেনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেন ভারতে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার বিরোধিতা করে বলেছেন, ‘শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে সন্ত্রাস দিয়ে দমনের চেষ্টা কখনও মেনে নেওয়া যাবে না।’ সুত্র: ভারতীয় দৈনিক ‘আজকাল’।