যেভাবে এলো বাংলা কবিতা

বাংলা সাহিত্যের আদিতে কবিতা ছাড়া অন্য কিছুর অস্তিত্ব ছিলো না। শুধু আদিতে নয় মধ্যযুগ পর্যন্ত সাহিত্য বলতে কবিতার অস্তিত্বই চোখে পড়ে, গদ্য বলে কোন কিছুই ছিলো না সেসময় পযর্ন্ত।

বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্যকর্মকেই বলা হয় বাংলা সাহিত্য। বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে ডঃ সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, আমাদের সংস্কৃতি সম্পর্কিত  বাঙ্গালা ভাষার সৃষ্টিকাল হইতে বাঙ্গালা ভাষায় রচিত যে সকল কাব্যে-কবিতায় ও অন্য সাহিত্যে আত্মপ্রকাশ করিয়াছে তাহাই বাঙ্গালা সাহিত্য। বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে এই মতটিই সর্বজন গ্রাহ্য।

 ডঃ সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় সতর্কতার সাথেই ‘কাব্য-কবিতা’ শব্দদ্বয় ব্যবহার করেছেন। এতে প্রমানিত হয় বাংলা সাহিত্যের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ কাব্য-কবিতাকেন্দ্রিক। আর ধারাবাহিক বাস্তবতাও তাই। 

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস হাজার বছর বা তার কিছু অধিক সময়ের ইতিহাস। সাহিত্যের ইতিহাস সর্বত্র সাল তারিখের হিসেব স্পষ্ট যুগ বিভাগ করা যায় না। সাল তারিখ দেখে যুগের আরম্ভ হয় না, যুগের পরিসমাপ্তিও ঘটেনা। সাহিত্যকর্মের বৈচিত্র্যে ও বৈশিষ্ট্যে নির্দিষ্ট যুগের চিহ্ন ও সাহিত্যের বিবর্তনের ধারাটি বিশ্লেষণ করেই সাহিত্যের ইতিহাসে যুগবিভাগ করা হয়ে থাকে।

বাংলা সাহিত্যের যুগ বিভাগও নির্ধারিত হয়েছে প্রাপ্ত নিদর্শনের ভিত্তিতে। এই ভিত্তিতে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস কে প্রধানত চারটি যুগে ভাগ করা হয়েছে।

আদিযুগ:  ৯৫০ থেকে ১২০০ খ্রীস্টাব্দ। নেপালের রাজসভায় আবিষ্কৃত “চর্যাপদ” এ যুগে রচিত।

ক্রান্তিযুগ : ১২০১ থেকে ১৩৫০ খ্রীস্টাব্দ। এ সময়ের বাংলা ভাষার কোন নমুনা পাওয়া যায় না।

মধ্যযুগ: ১৩৫১ থেকে ১৮০০ খ্রীস্টাব্দ। এ সময় বাংলা ভাষার লেখা সাহিত্য অনায়াসে পড়া যায় ও বোঝা যায়।

আধুনিক যুগ: ১৮০০ খ্রীস্টাব্দ থেকে বর্তমান। বহু নদী সরোবর পেড়িয়ে আজকের এই রূপ।

বাংলা সাহিত্যের আদিযুগঃ

বাংলা সাহিত্যে প্রচীন ও মধ্যযুগে গদ্য বলতে কিছু ছিল না। আদিযুগের পুরোটাই ছিল কাব্য কেন্দ্রিক। ১৯০৭ অব্দে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজ দরবারের গ্রন্থশালায় আবিষ্কার করেন এ যুগের চারটি পুঁথি। চরজ্যাচরজ্যবিনিশ্চয়,  দেহাকোষ-১, দেহাকোষ-২ ও ডাকার্ণব। এ গুলো পরবর্তীতে চর্যাপদ নামে পরিচিত হয়।

আলো-আধারির ভাষা

বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদ। চর্যাপদ কতগুলো আশ্চর্য কবিতার সমাহার। তাই চর্যাপদের আরেক নাম- চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়।

এতে আছে ২৪ জন বৌদ্ধ বাউলের লেখা ৪৬ টি পূর্ণ ও ১টি খন্ডিত গান। ‘চর্যা’  শব্দের অর্থ ‘আচরণ’। এতে নানা গানে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যেরা ধর্মের গূঢ় কথা বলেছেন – তাই এঁকে তান্ত্রিক গাঁথাও বলা যেতে পারে।

চর্যাপদের ভাষা অস্পষ্ট এবং প্রায় দুর্বোধ্য রীতিতে গঠিত, মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাই এই ভাষার নাম দিয়েছেন ‘সান্ধ্য কিংবা সন্ধ্যা ভাষা’। চর্যাপদের ছন্দ নির্ণয় করা হয়েছে মাত্রাবৃত্ত।

সান্ধ্যভাষায় রচিত খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত এই গীতিপদাবলীর রচয়িতারা ছিলেন সহজিয়া বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ। চর্যাপদ রচনার পেছনে তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিলো বৌদ্ধধর্মের গূঢ় অর্থ সাংকেতিক রূপের আশ্রয়ে ব্যাখ্যা করা।

মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী

মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজদরবারে রয়েল লাইব্রেরি থেকে মোট সাড়ে ছেচল্লিশটি পদ আবিষ্কার করেন। এর মধ্যে ২৪, ২৫ ও ৪৮ নং পদ পাওয়া যায়নি। সুতরাং এর মোট পদসংখ্যা ৫০।

চর্যাপদ, নামান্তরে কখনো কখনো ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’ বা ‘চর্যাগীতিকোষ’ এর রচয়িতার নাম ও সংখ্যাও এর বিষয় এবং ভাষার মতোই আলো আঁধারে খেলা করে। চর্যাপদের কবির সংখ্যা ২৩, মতান্তরে ২৪ (কারণ অনেকেই বলেন যে দারিকপা আর দাড়িম্বপা দুজন ব্যক্তি)।

কবিদের মধ্যে মীনপা, কুক্করীপা, ঢেণ্ডনপা, সানুপা, চৌরঙ্গীপা, শবরীপা, লুইপা, বিরূপা, ডোম্বীপা, তেলিপা, পরোপা, দারিম্পা, ভুসুকুপা, কাহ্নপা- এদের নাম জানা যায়। এদের মধ্যে প্রাচীনতম কবি লুইপা না সরহপা, এ নিয়েও রয়েছে তর্ক। সবচেয়ে বেশি পদ রচনা করেছেন কাহ্নপা।

“আপনা মাংসে হরিণা বৈরী” এই কথাটি আমাদের খুবই পরিচিত। কারো কোনো ভালো দিকই যখন তার জন্য খারাপ বা ক্ষতিকর কিছু বয়ে নিয়ে আসে, তখন আমরা এই কথাটি ব্যবহার করে থাকি। এই অতি পরিচিত উক্তিটিও এসেছে কবি ভুসুকুপার একটি পদ থেকে।

চর্যাকবিরা কল্পনার চাইতে যে বাস্তবকে অনেক বেশি আশ্রয় দিয়েছেন তাদের রচনায়, তার প্রমাণ হচ্ছে প্রায় প্রতিটি পদেই প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানের সরব উপস্থিতি। মানবশরীরকে বৃক্ষের সাথে তুলনা দিয়ে বলা হয়েছে ‘কায়াতরু’, যার পাঁচটি ডাল। এই পাঁচটি ডাল দ্বারা বোঝানো হয়েছে পঞ্চেন্দ্রিয়কে।

সমাজব্যবস্থার উল্লেখ:

২৬ নং চর্যায় বাঙালি তাঁতীদের শিল্পচাতুর্যের কথা পাওয়া যায়। ডোম জাতির নারীদের তাঁত বুনন ও তুলোধুনার কথা বর্ণিত হয়েছে একাধিক চর্যাপদে। ২১ নং চর্যায় আমরা পাই ইঁদুরের উপদ্রবে কৃষি বিপর্যস্ত হওয়ার কথা। এছাড়া ৪৫ নং চর্যায় কুঠারের সাহায্যে গাছ কাটার কথা বলা হয়েছে। তৎকালীন সমাজের অসঙ্গতি, অসম শাসনব্যবস্থা, দুঃখবোধ অনুভব করে সিদ্ধাচার্যগণ সহজিয়া সাধনায় সমতার ক্ষেত্রে মানবতাকে আহ্বান জানিয়েছেন।

জীবিকা নির্বাহ বা কর্মতালিকার পাশাপাশি তৎকালীন সমাজের শিল্প-সংস্কৃতির কথাও উঠে এসেছে চর্যাপদে। ১০ নং চর্যায় বর্ণন হয়েছে নটবৃত্তির কথা। বিনোদনের পাশাপাশি জীবিকা নির্বাহের অন্যতম উপায় হিসেবে তাদের নৃত্য-গীতের কলাকৌশল ছিল বিচিত্রমুখী। ১৭ নং চর্যায় জানা গেছে অভিনয়কলার কথাও।

চর্যার কিছু পদ:

এক গৃহবধূর অভিসারের ইঙ্গিত পাওয়া যায় কুক্করীপা রচিত ২ নং চর্যায়,

“দিবসহি বহুড়ী কাউহি ডর ভাই। রাতি ভইলে কামরু জাই।।”

অর্থাৎ, যে বধূটি দিনের বেলায় কাকের ভয়ে ভীতু হবার ভান করে, রাতের বেলায় সকলের অগোচরে সেই কামরূপ চলে যায়।

‘গঙ্গা জউনা মাঝে রে বহই নাঈ’ এর অর্থ- গঙ্গা যমুনার মাঝে নৌকা চলে।

তখনকার দরিদ্রের অনাহারের ক্রন্দন চর্যায় ব্যক্ত হয়েছে এভাবে,

    “টালত মোর ঘর নাহি পড়বেষী। হাড়ীতে ভাত নাহি নিতি আবেসী।।

    বেঙ্গ সংসার বডহিল জাঅ। দুহিল দুধু কি বেন্টে ষামায়।।”

এর অর্থ করা হয়েছে, টিলায় আমার ঘর, প্রতিবেশী নেই। হাঁড়িতে ভাত নেই, নিত্যই ক্ষুধিত (অতিথি)। (অথচ আমার) ব্যাঙের সংসার বেড়েই চলেছে (ব্যাঙের যেমন অসংখ্য ব্যাঙাচি বা সন্তান, তেমনি আমার সন্তানের সংখ্যাও ক্রমবর্ধমান)। দোয়ানো দুধ আবার বাঁটে ঢুকে যাচ্ছে। যে খাদ্য প্রায় প্রস্তুত, তা-ও নিরুদ্দেশ হয়ে যাচ্ছে।

চর্যাকবিরা আনন্দের নয়, বেদনার সুরেই রচেছেন এ সাহিত্য। তারা নিয়মিত জীবনের দুঃখ-কষ্ট-অভাব-বৈষম্য দেখে সইতে না পেরে চর্যা রচনা করেছেন।

আর প্রাচীন এই পদের হাত ধরেই আধুনিক কাব্যের পথচলা। নব নব রুপে নানা পথে, নানা আঙ্গিকে আধুনিক কবিতার পথচলা।