ঘন কুয়াশা আর হিম বাতাসে জবুথবু রংপুর

দেশ জুড়ে বাড়ছে শীতের তীব্রতা। ঘন কুয়াশা আর হিম বাতাসে স্থবির হয়ে পড়েছে উত্তরাঞ্চলের জনজীবন। মাঘের শুরুতেই জেঁকে বসেছে শীত। শৈত্যপ্রবাহ আর হাড় কাঁপানো শীতে এখন জবুথবু রংপুর।

তিস্তা-ঘাঘট, করতোয়া-যমুনেশ্বরী বিধৌত উত্তরের এ জেলার প্রকৃতি মুড়ে আছে ঘন কুয়াশার চাদরে। হিমেল হাওয়া মাখা কনকনে ঠান্ডায় বেশিরভাগ শ্রমজীবী ও নিম্ন আয়ের মানুষ পড়েছে চরম ভোগান্তিতে। স্থবির হয়ে পড়েছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা।

মঙ্গলবার (১৯ জানুয়ারি) মধ্যরাত থেকে শীতের তীব্রতা বাড়তে শুরু করে। ভোরে তা আরও বেশি করে জেঁকে বসে। গত শনিবার (১৬ জানুয়ারি) থেকে এ রকম শীত কাঁপাচ্ছে জেলার মানুষদের। তীব্র শীতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।

গেল তিনদিন ধরে কনকনে হিমেল হাওয়া বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমেছে তাপমাত্রা। বাতাসের আর্দ্রতা বেড়ে যাওয়ায় শীত আর ঠান্ডার প্রকোপ বেশি অনুভূত হচ্ছে। এ রকম মৃদু থেকে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ আরও এক-দুইদিন স্থায়ী হতে পারে বলে জানিয়েছে স্থানীয় আবহাওয়া অফিস।

মঙ্গলবার সকাল ৯টায় রংপুরে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ১৩ দশমিক শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগের দিন সোমবার (১৮ জানুয়ারি) এ জেলায় সবনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর রোববার (১৯ জানুয়ারি) ১০ দশমিক ৫ ডিগ্রি এবং শনিবার (১৬ জানুয়ারি) ১১ দশমিক শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। দিন যত যাচ্ছে তাপমাত্রার পারদ ওঠানামা করার সঙ্গে বাড়ছে ঘন কুয়াশা। এতে শীতের ধকল বয়ে যাচ্ছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর দিয়ে।

উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়াতে আজ দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে।

এদিকে কুয়াশায় ধোঁয়াচ্ছন্ন পরিবেশে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছে দিনমজুর ও নিম্ন আয়ের মানুষেরা। শ্রম বিক্রির অপেক্ষায় থাকা শ্রমিকেরা খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন। তবে উষ্ণতার জন্য প্রয়োজনীয় মোটা কাপড়ের অভাবে শীতের ধকলে নাকাল তারা।

রংপুর নগরের শাপলা চত্বর, পায়রা চত্বর, বেতপট্টি মোড়, পার্কের মোড় ও টার্মিনাল এলাকায় শ্রমিকদের জটলা দেখা গেছে। খড়কুটোতে আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছে এসব হতদরিদ্র মানুষ। শহর-গ্রামে রাস্তায় থাকা ছিন্নমূল অসহায় মানুষগুলোর কষ্ট  বেড়ে গেছে।

শাপলা চত্বরে শ্রম বিক্রি করতে আসা রজব আলী বলেন, ‘হামরা গরিব মানুষ, ঠান্ডা হোক আর গরমে হোক কাম করিবার নাগবেই। একদিন কাম না করলেও খামো কী? কায় হামাক খাবার দেবো।’

‘ঠান্ডা বাতাসোত কষ্ট তো হওচে। কিন্তু কিছুই করার নাই। কোনোটে কামের খোঁজ আসলে যাওয়া লাগবেই।’ কথাগুলো বলছিলেন বেতপট্টি এলাকায় শ্রম বিক্রির অপেক্ষায় থাকা জহির উদ্দিন।

রংপুর সদরের সদ্যপুস্করণী ইউনিয়নের পালিচড়ার এই বাসিন্দা বলেন, ‘গত বছর চেয়ারম্যান একান কম্বল দিছিল। এবার তো কারও খোঁজ খবর নাই। কয়দিন আগোত হামার এমপি সাইব জাম্পার দিচে, সেটাও তো পাও নাই বাহে।’

শুধু দিনমজুরেরা নয়, তীব্র শীতে কাতর হয়ে পড়েছে শিশু ও বৃদ্ধরা। খড়কুটোতে আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছে হতদরিদ্র মানুষ। সূর্যের দেখা মিললেও ঠান্ডা বাতাসে হারিয়ে গেছে উষ্ণতা।

এদিকে মঙ্গলবার ভোর থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত রংপুর নগরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ঘন কুয়াশার দাপটে সড়কে মানুষের উপস্থিতি কম। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কর্মস্থলে যেতে বের হওয়া মানুষদের ঠিকই দেখা গেছে। সড়কে অটোরিকশা, চার্জার রিকশা, মোটরসাইকেলসহ হালকা যানবাহন কম চলাচল করতে দেখা গেছে

সড়কে দূরপাল্লার গাড়িগুলো হেডলাইট জ্বালিয়ে চলাচল করছে। কুয়াশাচ্ছন্ন প্রকৃতির কারণে বিমান ও ট্রেনের শিডিউল কিছুটা বিলম্ব হতে পারে বলে জানা গেছে।

রংপুর আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মঙ্গলবার রংপুরে সকাল ৯টা পর্যন্ত তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে ১১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর সূর্যোদয় হয়েছে ভোর ৬টা ৫৭মিনিটে। তবে সূর্যের উত্তাপ গায়ে লাগেনি।

তিনি আরও জানান, মৃদু শৈত্যপ্রবাহ আর বাতাসের আর্দ্রতা বেড়ে যাওয়ায় শীত আর ঠান্ডার প্রকোপ বেড়ে গেছে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে। জানুয়ারির শেষ দিকে দুটি শৈত্যপ্রবাহের সম্ভাবনা রয়েছে বলেও জানান তিনি।

এদিকে শীতজনিত নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্ট, পেটব্যথা, জন্ডিস, সর্দি-জ্বরে ভুগছে শিশু ও বৃদ্ধরা। এ কারণে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উত্তরাঞ্চলের বহু মানুষ প্রতিদিন চিকিৎসা নিতে আসছেন। এর মধ্যে শিশু ও বৃদ্ধা বয়সের মানুষ বেশি।

রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. রুস্তম আলী জানান, গেল এক সপ্তাহে হাসপাতালে শীতজনিত রোগে মারা গেছেন ১৭ জন। আর ভর্তি হয়েছেন এক হাজার ৩২২ জন। শীতের সময়টাতে এমন রোগব্যাধি বাড়ে। আতঙ্কিত না হয়ে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। 

ডা. রুস্তম আলী বলেন, আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণে চেষ্টা করা অনেকেই অগ্নিদদ্ধ হয়ে হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। গত দুদিনে রমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অগ্নিদগ্ধ এক অন্তঃসত্ত্বা নারীসহ দুজনের মৃত্যু হয়েছে।

এদিকে শীত পরিস্থিতি মোকাবেলায় জেলায় সরকারি, বেসরকারি উদ্যোগে শীতার্তদের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। এ ব্যাপারে রংপুরের জেলা প্রশাসক আসিব আহসান জানান, শীতের শুরুতেই রংপুরে শীতবস্ত্র বিতরণ কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়। ইতোমধ্যে জেলার আট উপজেলায় ইউএনওদের মাধ্যমে ৫১ হাজার ৬০০ কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া আরও ৫৩ লাখ টাকা সমমূল্যের শীতবস্ত্রের চাহিদা সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

এনএ/রাতদিন

মতামত দিন