রংপুরের পীরগাছা উপজেলায় পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিকসহ কার্বামেট ও অর্গানো ফসফেট জাতীয় বিষের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। শুধুমাত্র আর্সেনিকোসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে গত ২২ বছরে মারা গেছে সাত জন। এছাড়া শতাধিক লোক এ রোগে আক্রান্ত হয়ে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে। অর্থ বরাদ্দ নেই বলে আর্সেনিক প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। ফলে বিস্তার ঘটছে আর্সেনিকের, বাড়ছে আর্সেনিকোসিস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা।
বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের আওতাধীন পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৮ সালে উপজেলার প্রায় ৭৫ হাজার পরিবারের ব্যবহৃত নলকুপের পানি পরীক্ষা করে ৮.০৫ মাত্রার আর্সেনিকের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। আর আর্সেনিকোসিসে আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায় প্রায় ৩০০ জন। এলাকার নলকূপগুলোতে ৭০ ফুট লেয়ারের মধ্যে আর্সেনিকের সন্ধান মেলে।
ওই প্রতিষ্ঠানের একদল বিজ্ঞানী পীরগাছা উপজেলার পানিতে কার্বামেট ও অর্গানো ফসফেট জাতীয় বিষের অস্তিত্ব পান। ভূ -উপরিস্থ পানির ২৪টি নমুনা এবং পাঁচটি গভীর নলকূপের পানি পরীক্ষা করে তাতে উচ্চ মাত্রার কার্বামেট ও অর্গানো ফসফেট জাতীয় রাসায়নিক উপাদানের উপস্থিতি পাওয়া যায়। এর মধ্যে ধানক্ষেতের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত কার্বোফুরান ও কার্বোরিলের উপাদান মেলে। অন্যদিকে খাবার পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক ও নাইট্রেট পাওয়ার নজির রয়েছে।
পাঠক শিকড় গ্রামের আর্সেনিকোসিসে আক্রান্ত আসাদুল ইসলাম (৩০) বলেন, তাঁর বাড়িতে আর্সেনিকমুক্ত নলকূপ নেই। ফলে আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করে তাঁর বাবা মেনাজ উদ্দিন আর্সেনিকোসিস রোগে পঙ্গু হয়ে মারা গেছেন। বর্তমানে তিনিও আর্সেনিকোসিসে আক্রান্ত। ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারছেন না।
আর্সেনিকোসিসে আক্রান্ত তছলিম উদ্দিন বকসি বলেন, ‘প্রথম দিকে স্বাস্থ্য বিভাগের লোক এসে ওষুধ দিয়ে যেতেন। কিন্তু এখন আর কেউ খোঁজ নেয় না। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের মরণ ছাড়া কোনো উপায় নেই।’
- পীরগাছায় ২২ বছরে সাত জনের মৃত্যু
- পানিতে উচ্চ মাত্রার কার্বামেট ও অর্গানো ফসফেট
- ধানক্ষেতের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত কার্বোফুরান ও কার্বোরিলের উপাদান
- খাওয়ার পানিতে অতিরিক্ত আর্সেনিক ও নাইট্রেট
- আক্রান্তদের দুর্বিষহ জীবন যাপন
- বেশীরভাগ পরিবার আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করছে
সরেজমিনে পাঠক শিকড়সহ কয়েকটি গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, সরকারিভাবে বসানো নলকূপ নষ্ট হয়ে পড়ে রয়েছে। গ্রামের নারীরা জগ, কলসি ও বালতিতে করে দূর থেকে আর্সেনিকমুক্ত পানি নিয়ে আসছেন।
গৃহবধূ আনোয়ারা বেগম, ও হাসিনা বেগম জানান, ‘প্রতিদিন দূর থেকে পানি আনতে তাঁদের বেশ কষ্ট হয়। টাকার অভাবে তাঁরা বাড়িতে আর্সেনিকমুক্ত গভীর নলকূপ বসাতে পারছেন না। আবার অনেকে বাধ্য হয়ে কম খরচে বসানো নলকূপের আর্সেনিকযুক্ত পানিই পান করছে। ’
গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে পাঠক শিকড় গ্রামের বাবলু মিয়া, তছলিম উদ্দিন বকসি, আবদুল হামিদ, আসাদুল ইসলাম, আবদুল করিম, মফিজ উদ্দিন, আবদুর রহমান, হামিদ আলী, আবদুর রহিম ও আনোয়ারা বেগমসহ শতাধিক ব্যক্তি আর্সেনিকোসিস রোগে আক্রান্ত। তাঁদের চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেই।
স্থানীয় সূত্র জানায়, ১৯৯৮ সালের এপ্রিল মাসে পাঠক শিকড় গ্রামের আবদুর রহমান ও হামিদ আলীর বাড়ির নলকূপের পানিতে প্রথম সহনীয় মাত্রার অধিক আর্সেনিক ধরা পড়ে। প্রথমে তাঁদের চোখ-মুখ ফুলে যায়, জ্বর অনুভব হতে থাকে ও পুরো শরীর কালো হয়ে যায়। পরে হাত-পায়ে ফোসকা পড়ায় চলাফেরা করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। ঘটনাটি নিয়ে তখন তোলপাড় শুরু হয়।
ওই দুটি পরিবারের ১১ ব্যক্তি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে পরীক্ষা করে তাদের শরীরে আর্সেনিকোসিস রোগের সংক্রমণ ধরা পড়ে। এ ঘটনার পর স্থানীয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ওই গ্রামের ২৯৮টি পরিবারের ১৬৮টি নলকূপের পানি পরীক্ষা করে ৭৫টিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিকের সন্ধান পায়। এ সময় ৫৩ জন আর্সেনিকোসিস রোগে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করে।
আক্রান্ত ব্যক্তিদের কয়েকজনকে পীরগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। এদের মধ্যে মারাত্মক আর্সেনিকোসিসে আক্রান্ত ১২ জনকে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর ২২ বছরে তাঁদের মধ্যে গুরুতর অসুস্থ হয়ে ওয়াজেদ আলী, নজিনা বেগম, নুরুল ইসলাম, এন্তাজ আলী, তাঁর ছেলে জব্বার আলী ও আব্বাস আলী এবং মেনাজ উদ্দিন মারা যান।
সংশ্লিষ্ট বিভাগ আর্সেনিক পাওয়া নলক‚পগুলো সিলগালা করে এর চেয়ে বেশি গভীরতায় ৩৬৫টি হস্তচালিত নলক‚প, ৬৩টি তারা পাম্প-১ ও সাতটি তারা পাম্প-২ স্থাপন করে। কিন্তু এগুলোর বেশির ভাগই এখন অকেজো হয়ে পড়ে আছে। আর চালু নলক‚পগুলোও পর্যাপ্ত আর্সেনিকমুক্ত নয়।
কান্দি ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম খান বলেন, পাঠক শিকড় গ্রামে আর্সেনিকমুক্ত পানীয় জলের কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা নেই। সেখানে সরকারিভাবে কয়েকটি নলকূপ বিতরণ ছাড়া অন্য কোনো সহায়তা দেওয়া হয়নি। বর্তমানে এ গ্রাম ছাড়াও দাদন, কাবিলাপাড়া, দোয়ানী মনিরাম ও মনিরামপুর গ্রামে আর্সেনিকের ব্যাপকতা ছড়িয়ে পড়েছে।
উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপ-সহকারী প্রকৌশলী তুহিন হাসান বিশ্বাস জানান, সরকারিভাবে কোনো বরাদ্দ না থাকায় আর্সেনিক আক্রান্ত গ্রামগুলোতে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে মুজিব বর্ষ উপলক্ষে উপজেলার ৯টি ইউনিয়নে ২৬টি করে নলকূপ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।’
এ বিষয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আবু আল হাজ্জাজ বলেন, পানি ফুটিয়ে সাধারণ জীবাণুমুক্ত করা গেলেও রাসায়নিকের দূষণমুক্ত করা যায় না। ফলে রাসায়নিকের দূষণযুক্ত পানি বিপদ বয়ে আনবেই। আর অতিমাত্রার আর্সেনিকযুক্ত পানি মানবদেহের জন্য যেমন মারাত্মক ক্ষতিকর, তেমনি গবাদিপশুর জন্যও ক্ষতির কারণ।
এমএস/রাতদিন