সম্প্রতি চীনের উহান প্রদেশ থেকে ছড়িয়ে পড়া নভেল করোনা ভাইরাসে কাঁপছে গোটা দুনিয়া। চীনসহ বিশ্বের দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ছে এ ভাইরাসের সংক্রমণ। গত একমাসের ব্যবধানে করোনা ভাইরাসে মৃতের সংখ্যা ২ হাজার ছাড়িয়েছে। আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন অর্ধলক্ষাধিক মানুষ। এটি এই শতকের সবচেয়ে ভয়াবহ মহামারি কিনা ইতিহাস সেটি বলবে। তবে ইতিহাস বলছে প্রতি ১০০ বছরে মানব ইতিহাসে একবার করে ফিরে আসে এসব মহামারি।
গত দুই হাজার বছরের ইতিহাস পর্যালোচনায় এমনটাই দেখা গেছে। আর এসময়ে এসব মহামারি কেড়ে নিয়েছে কোটি কোটি মানুষের প্রাণ। মানব ইতিহাসে ভয়ঙ্কর এসব মহামারিতে বহু নগর সভ্যতা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এমনকি বদলে গেছে পৃথিবীর মানচিত্রও।
ভয়ংকর এসব মহামারিগুলো হলো:
প্রথম শতাব্দী
১৬৫ খ্রিস্টাব্দে রোমে গুটিবসন্ত হানা দিয়েছিল। তখন মৃত্যুর হাত থেকে পালিয়েও বাঁচতে পারেনি ওই জনপদের মানুষ। মাত্র ১৫ বছরের ব্যবধানে রোম হয়ে উঠেছিল ভূতের শহর। গোটা পৃথিবীতে এই রোগে মারা গিয়েছিলো প্রায় ৪৫ লাখ মানুষ।
দ্বিতীয় শতাব্দী
প্রায় পৌনে দুই হাজার বছর আগে ২৫০ খ্রিস্টাব্দে সাইপ্রিয়ানের প্লেগ রোগ মহামারি আকার ধারণ করে। এটি সেসময় রোমান সাম্রাজ্যকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল।
পঞ্চম শতাব্দী
পঞ্চম শতাব্দিতে রোমান সাম্রাজ্যের ভিত আরও কাঁপিয়ে দিয়েছিল মহামারি প্লেগ। বর্তমান ইরান, মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে ‘প্লেগ অব শ্যারো’ মহামারিতে তখন এক বছরে এক লক্ষ মানুষের প্রাণহানি হয়েছিল। পার্সিয়ার অর্ধেক মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।
ষষ্ঠ শতক
এর ঠিক ১০০ বছর পর অর্থাৎ ষষ্ঠ শতকের প্রথমার্ধে ইউরোপ, মিশর ও পশ্চিম এশিয়ায় প্লেগের ছোবলে গোটা পৃথিবীর প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।
অষ্টম শতাব্দী
পরবর্তীতে ৭৩৫ থেকে ৭৩৭ সাল, এই দুবছরে গুটিবসন্ত বা স্মল পক্সের ছোবলে জাপান প্রায় জনমানবহীন হয়ে পড়েছিল। জাপানে এক তৃতীয়াংশ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল তখন।
চতুর্দশ শতাব্দী
১৩৪৬ থেকে ১৩৫৩ এই সময়কালেও প্লেগের সবচাইতে ভয়ানক থাবা সহ্য করেছিল মানব সম্প্রদায়। যা ইতিহাসে ব্ল্যাক ডেথ নামে কুখ্যাতি পেয়েছিল। এতে আক্রান্ত হয়ে তখন প্রায় ৮ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।
প্লেগ মহামারির কড়াল গ্রাসে চতুর্দশ শতকেই বিশ্বের মোট জনসংখ্যা ৪৫০ মিলিয়ন থেকে ৩৭৫ মিলিয়নে নেমে আসে।
ষোড়শ শতাব্দী
ষোলো শতকে নিউ স্পেনে (বর্তমান মেক্সিকো) স্যালমোনেলা জাতীয় ব্যাকটেরিয়ায় পুরোপুরি ধ্বংসের মুখে পড়েছিল অ্যাজটেক সভ্যতা। ওই জনপদের ৮০ শতাংশ মানুষ মারা গিয়েছিল। এর পর ১৫৬৩ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনে প্লেগে ২০ হাজার মানুষের প্রাণহানি হয়।
সপ্তদশ শতাব্দী
লন্ডনে সবচেয়ে বীভৎস মহামারির আঘাতটি এসেছিল ১৬১৬ সালে। সে বছর স্মল পক্স, ইনফ্লুয়েঞ্জা, টাইফাসসহ অজানা কিছু ভাইরাস জ্বলে শহরটির ৯০ শতাংশ মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল। গোটা লন্ডন শহরটি হয়ে উঠেছিল মৃত্যুপুরী। এর প্রায় ১৫ বছর ১৬২৯-১৬৩১ সালে ইতালিতে প্লেগের থাবায় আড়াই লাখ মানুষের অকাল মৃত্যু হয়েছিল।
অষ্টাদশ শতাব্দী
এই শতকে নতুন কোন মহামারির প্রাদূর্ভাব না হলেও ১৭৩৮ সালে প্লেগে বলকান অঞ্চলে অর্ধলক্ষ মানুষের প্রাণহানি হয়েছিল। ওই শতকেই রাশিয়া ও পার্সিয়ায় মৃত্যু হয় দুই লাখ মানুষের।
ঊনবিংশ শতাব্দী
উনিশ শতকে পৃথিবীতে হানা দেয় নতুন মহামারি কলেরা। মাত্র ১০ বছরের ব্যবধানে ইউরোপ ও এশিয়ায় মৃত্যু হয় এক লাখ মানুষের। ওই সময় কলেরা প্রতিরোধের কোনও উপায়ও জানা ছিল না। তখন কলেরা মানেই মৃত্যু ছিল নিশ্চিত। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া কলেরায় তখন লাখ লাখ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছিল। শুধু রাশিয়াতেই মারা যায় এক লাখ মানুষ।
বিংশ শতাব্দী
বিংশ শতাব্দির শুরুতে তামাম দুনিয়ায় আতঙ্কের নাম হয়ে উঠেছিল ইনফ্লুয়েঞ্জ। এই রোগে প্রায় এক লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। ওই শতকেই চীনে প্লেগ কেড়ে নেয় আরও প্রায় ৫০ হাজার মানুষের প্রাণ।
তবে বিশ শতকে সবচেয়ে আলোচিত মহামারির নাম ছিল এশিয়ান ফ্লু। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশে ছড়িয়ে পড়া এই রোগে দুই লক্ষেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়।
এরপর ১৯৬০ সালে দেখা দেয় এইচআইভি বা এইডসের ছোবল। এই ভাইরাসে এখন পর্যন্ত গোটা দুনিয়ায় ৩০ লাখ মানুষ মারা গেছে। এসময় পোলিওতেও বিশ্বের নানা প্রান্তে বহু মানুষের প্রাণ ঝরেছে।
একবিংশ শতাব্দী
একুশ শতকে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় মহামারি হিসেবে আঘাত হেনেছে নভেল করোনা ভাইরাস। একবিংশ শতাব্দির প্রথম দুই দশকেই সার্স, মার্স, ডেঙ্গু, জিকা, ইবোলার মতো মারণ ভাইরাসের মুখে পড়েছে পৃথিবী। তবে ২০২১ সালের শুরুতে নতুন শতকের আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে করোনা ভাইরাস। এ ভাইরাসে এখন পর্যন্ত প্রায় পৌনে এক লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। ২৮টি দেশে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে প্রায় ২ সহস্রাধিক মানুষের।
জেএম/রাতদিন