রংপুরের জামায়াত নেতা ‘কসাই’ আজহারের মৃত্যুদন্ড বহাল

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামকে দেওয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ। রংপুর অঞ্চলে ব্যাপক গণহত্যা ও ধর্ষণের ঘটনায় সম্পৃক্ততার কারনে তিনি ওই এলাকায় ‘কসাই আজহার’ নামে পরিচিত।

বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর সকাল ৯টা ৫ মিনিটে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের চার বিচারপতির বেঞ্চ এ রায় দেন।

বেঞ্চের অপর তিন সদস্য হলেন- বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি জিনাত আরা ও বিচারপতি মো. নুরুজ্জামান।

ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদণ্ডাদেশের রায়ের বিরুদ্ধে আজহারের করা আপিল আংশিক মঞ্জুর করে তিনটি অভিযোগে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।

এর মধ্যে দুই অভিযোগের একটিতে তার সাজা বহাল রাখা হয়েছে এবং আরেকটিতে খালাস দেওয়া হয়েছে। 

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় রংপুর অঞ্চলে এক হাজার ২৫৬ ব্যক্তিকে গণহত্যা-হত্যা, ১৭ জনকে অপহরণ, একজনকে ধর্ষণ, ১৩ জনকে আটক, নির্যাতন ও গুরুতর জখম এবং শত শত বাড়ি-ঘরে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের মতো ৯ ধরনের ছয়টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয় এটিএম আজহারের বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগের মধ্যে ১ নম্বর বাদে বাকি পাঁচটি অভিযোগই প্রমাণিত হয়েছে ট্রাইব্যুনালের রায়ে। সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির (ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায়) অভিযোগ ছাড়াও তিনি যে আলবদর কমান্ডার ছিলেন তাও প্রমাণিত হয় রায়ে।

এছাড়া ওই অঞ্চলের এক নারীকে রংপুর টাউন হলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্যাতন কেন্দ্রে ধর্ষণের জন্য তুলে দেয়ার অভিযোগে তাকে ২৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং অপহরণ ও আটক রেখে নির্যাতনের আরেকটি ঘটনায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়।

গত ১০ জুলাই আজহারের আপিলের ওপর শুনানি শেষে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখা হয়েছিল। ১১২ দিন পর বুধবার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে বৃহস্পতিবারের কার্যতালিকায় রায় ঘোষণার জন্য আজহারের আপিলটি এক নম্বর ক্রমিকে আসে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আসা এটি অষ্টম মামলা, যার রায় হয়েছে।

আদালতে আজহারের পক্ষে শুনানি করেছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন। তার সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী শিশির মনির। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তার সঙ্গে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ দেবনাথ।

মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আজহারকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর সদস্য বিচারপতি আনোয়ারুল হক ও বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন এ রায় দেন৷ রায়ে বলা হয়, আজহারের বিরুদ্ধে গঠন করা ছয়টি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে গণহত্যা, হত্যা ও অগ্নিসংযোগের তিনটি অভিযোগে তাকে সর্বোচ্চ সাজা (মৃত্যুদণ্ড) দেওয়া হয়। ধর্ষণ, অপহরণ, আটক ও নির্যাতনের দু’টি অভিযোগে তাকে মোট ৩০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়।

২০১২ সালের ১৫ এপ্রিল আজহারের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অভিযোগের তদন্ত শুরু হয়৷ একই বছরের ২২ আগস্ট মগবাজারের বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়৷ ওইদিনই গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছিল ট্রাইব্যুনাল৷

২০১৩ সালের ১৮ জুলাই রাষ্ট্রপক্ষ আজহারের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে এবং ২৫ জুলাই অভিযোগ আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল৷ একই বছরের ১২ নভেম্বর মানবতাবিরোধী অপরাধে ছয়টি অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে আজহারের বিরুদ্ধে মামলার বিচার কাজ শুরু হয়৷ তদন্ত কর্মকর্তা ইদ্রিস আলীসহ ১৯ জন সাক্ষী উপস্থাপন করে রাষ্ট্রপক্ষ৷ ২০১৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়৷

মুক্তিযুদ্ধের সময় রংপুরের আলবদর নেতা ছিলেন আজহার। ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের ২৮ জানুয়ারি আপিল করেন আজহার। এ আপিলের ওপর গত ১৮ জুন শুনানি শুরু হয়। আসামিপক্ষে অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড জয়নুল আবেদীনের পেপারবুক উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে এ শুনানি শুরু হয়েছিল। শুনানি ষষ্ঠ দিনে গত ১০ জুলাই শেষ হয়।

এনএ/রাতদিন