মুসলিম বিশ্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস রমজান মাস। প্রতি বছর কোটি কোটি ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা এ সময় রোজা রাখেন সূর্যোদোয় হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত কোনো প্রকার খাদ্য গ্রহণ না করে। এই যে মুসলিমরা একমাস ধরে রোজা রাখেন, সেটা তাদের শরীরে কী প্রভাব ফেলে তা নিয়ে প্রতিবেদন করেছে আন্তজার্তিক গণমাধ্যম বিবিসি।
বিগত কয়েক বছর ধরে উত্তর গোলার্ধের দেশগুলোতে রমজান পালিত হচ্ছে গ্রীষ্মকালে। ফলে এসব দেশের মুসলিমদের রোজা রাখতে হচ্ছে গরমের মধ্যে অনেক দীর্ঘসময় ধরে। যেমন নরওয়ের মুসলিমদের এ বছর সময় ধরে প্রায় ২০ ঘন্টা রোজা রাখতে হবে।
শেষ বার খাদ্য গ্রহণের আট ঘন্টা পার না হওয়া পর্যন্ত কিন্তু মানুষের শরীরে সেই অর্থে রোজার প্রভাব পড়ে না। আমরা যে খাবার খাই, তা পাকস্থলীতে পুরোপুরি হজম হতে এবং এর পুষ্টি শোষণ করতে শরীর অন্তত আট ঘন্টা সময় নেয়।
আর এই খাদ্য যখন পুরোপুরি হজম হয়ে যায়, তখন আমাদের শরীর যকৃৎ ও মাংসপেশীতে সঞ্চিত হয় যে গ্লুকোজ, সেটা থেকে শক্তি নেয়ার চেষ্টা করে।
যখন শরীর এই চর্বি খরচ করতে শুরু করে, তা আমাদের ওজন কমাতে সাহায্য করে। এটি কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায় এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়।
আবার এসময় রক্তে সুগার বা শর্করার মাত্রা কমে যায়, সে কারণে হয়তো কিছুটা দুর্বল এবং ঝিমুনির ভাব আসতে পারে। এছাড়াও অনেকের ক্ষেত্রে মাথাব্যাথা, মাথা ঘোরা, বমি বমি ভাব বা নিশ্বাসে দুর্গন্ধ হতে পারে। আর এ সময়ই রোজাদারদের সবচেয়ে বেশি ক্ষুধা লাগে।
প্রথম কয়েকদিনের পর রোজাদারদের শরীর যখন অভ্যস্ত হয়ে উঠে, তখন শরীরে চর্বি গলে গিয়ে তা রক্তের শর্করায় পরিণত হচ্ছে। কিন্তু রোজার সময় দিনের বেলায় যেহেতু কিছুই খেতে বা পান করতে পারে না, তাই রোজা ভাঙ্গার পর অবশ্যই রোজদার ব্যক্তিকে সেই ঘাটতি পূরণ করার জন্য প্রচুর পানি পান করতে হবে। নইলে মারাত্মক পানি-শূন্যতায় আক্রান্ত হতে পারে। বিশেষ করে গরমের দিনে যদি শরীরে ঘাম হয়।
আর খাদ্য গ্রহণের তালিকায় যথেষ্ট শক্তিদায়ক খাবার থাকতে হবে। যেমন কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা এবং চর্বি। রোজায় ভারসাম্যপূর্ণ খাবার খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই সব ধরণের পুষ্টি, প্রোটিন বা আমিষ, লবণ এবং পানি থাকবে এই ধরণে রাখতে হবে।
রমজান নিয়ে ক্যামব্রিজের এডেনব্রুকস হাসপাতালের ‘অ্যানেসথেসিয়া এন্ড ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিনের’ কনসালট্যান্ট ড. রাজিন মাহরুফ বলেন, এর অন্যান্য সুফলও আছে।
ড. রাজিন বলেন,‘সাধারণত দৈনন্দিন জীবনে আমরা অনেক বেশি ক্যালরিযুক্ত খাবার খাই এবং এর ফলে আমাদের শরীর অন্য অনেক কাজ ঠিকমত করতে পারে না, যেমন ধরুণ শরীর নিজেই নিজেকে সারিয়ে তুলতে পারে।’
তিনি আরো বলেন,‘কিন্তু রোজার সময় যেহেতু আমরা না খেয়ে থাকছি, তাই শরীর তখন অন্যান্য কাজের দিকে মনোযোগ দিতে পারে। কাজেই রোজা কিন্তু শরীরের জন্য বেশ উপকারী। এটি শরীরের ক্ষত সারিয়ে তোলা বা সংক্রমণ রোধে সাহায্য করতে পারে।’
রমজান মাসের দ্বিতীয়ার্ধে রোজাদারদের শরীর পুরোপুরি রোজার সঙ্গে মানিয়ে নেবে। এ সময় শরীরের পাচকতন্ত্র, যকৃৎ, কিডনি এবং দেহত্বক এখন এক ধরণের পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাবে। সেখানে থেকে সব দূষিত বস্তু বেরিয়ে শরীর পবিত্র হয়ে উঠবে।
এ নিয়ে ড. মাহরুফ বলেন, ‘এসময় শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তাদের পূর্ণ কর্মক্ষমতা ফিরে পাবে। স্মৃতি এবং মনোযোগের উন্নতি হবে এবং শরীরে অনেক শক্তি পাবে। শরীরের শক্তি জোগানোর জন্য আমিষের ওপর নির্ভরশীল হওয়া ঠিক হবে না। যখন শরীর ‘ক্ষুধার্ত’ থাকছে তখন এটি শক্তির জন্য দেহের মাংসপেশীকে ব্যবহার করছে। এবং এটি ঘটে যখন একটানা বহুদিন বা কয়েক সপ্তাহ ধরে রোজা রাখছেন।’
তিনি আরো বলেন, ‘যেহেতু রোজার সময় কেবল দিনের বেলাতেই আপনাকে না খেয়ে থাকতে হয়, তাই আমাদের শরীরের চাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্ট খাবার এবং তরল বা পানীয় গ্রহণের সুযোগ থাকছে রোজা ভাঙ্গার পর। এটি আমাদের মাংসপেশীকে রক্ষা করছে এবং একই সঙ্গে আমাদের আবার ওজন কমাতেও সাহায্য করছে।’
রোজা রাখা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো কিনা এমন প্রশ্নে ড: মাহরুফ বলেন, অবশ্যই, তবে একটা ব্যাপার আছে।
এ নিয়ে ড. মারুফ বলেন, ‘রোজা রাখা শরীরের জন্য ভালো কারণ আমরা কী খাই এবং কখন খাই সেটার ওপর আমাদের মনোযোগ দিতে সাহায্য করে। কিন্তু একমাসের রোজা রাখা হয়তো ভালো। কিন্তু একটানা রোজা রেখে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া যাবে না।’
তিনি আরো বলেন, ‘শরীরের ওজন কমানোর জন্য একটানা রোজা রাখা কোনো উপায় হতে পারে না। কারণ একটা সময় আপনার শরীর চর্বি গলিয়ে তা শক্তিতে পরিণত করার কাজ বন্ধ করে দেবে। তখন এটি শক্তির জন্য নির্ভর করবে মাংসপেশীর উপর। এটা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়। কারণ আপনার শরীর তখন ক্ষুধায় ভুগবে।’
এজন্য ড. মাহরুফ পরামর্শ দেন, রমজান মাসের পর মাঝে মধ্যে অন্যভাবে না খাওয়া যেতে পারে। যেমন ৫:২ ডায়েট (পাঁচদিন কম খেয়ে দুদিন ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া করা)। যেখানে কয়েকদিন রোজা রেখে আবার স্বাস্থ্যসম্মতভাবে খাওয়া-দাওয়া করা যেতে পারে।