মায়ের ভালোবাসা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলার কোন অবখাশ নেই পৃথিবীতে। প্রত্যেক মা চায় তার সন্তানেরা বেঁচে থাকুক, ভালো থাকুক। পার্থিব সকল প্রতিকুলতায় আচল দিয়ে সন্তানকে আগলে রাখেন মা। তবে এর ব্যতিক্রম দেখা গেল কুড়িগ্রামে। অভাবের তাড়নায় নিজের দুই কন্যা সন্তানকে বিক্রি করে দিয়েছেন এক অসহায় মা।
কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার বুড়াবুড়ী ইউনিয়নের শিমুলতলা গ্রাম। এই এলাকার ফকির মোহাম্মদ গুচ্ছ গ্রামে বসবাস করেন শারীরিক প্রতিবন্ধী মর্জিনা বেগম (৩৫)। মানসিক ভারসাম্যহীন স্বামী ও সাত সন্তানকে নিয়ে থাকেন তিনি। প্রতিনিয়ত টানাপোড়েনে চলে তার সংসার। দুবেলা খাবার যোগাতে হিমশিম খেতে হয় মর্জিনা বেগমকে। বাপের বাড়ি ও প্রতিবেশীদের সহযোগিতায় খেয়ে না খেয়ে দিন কাটে তাদের।
মর্জিনার সাত সন্তানের মধ্যে রয়েছে তিন ছেলে ও চার মেয়ে। অভাবের কারণে কোনো সন্তানকেই এখনও স্কুলে ভর্তি করতে পারেনি দম্পতিটি। এমনকি অপুষ্টিতে ভুগে এক সন্তান মারাও গেছে। জীবিত থাকা সকল সন্তানই অপুষ্টিতে ভুগছে বলে জানা গেছে।
সন্তানদের ভরণ-পোষণ দিতে বেগ পোহাতে হয় মর্জিনা বেগমকে। ছোট সন্তানদের বিভিন্ন জায়গায় কাজে পাঠালেও ফিরে এসেছে তারা। অবশেষে নিজের দুই কন্যা সন্তানকে বিক্রি করে দিতে পিছু পা হননি তিনি। আড়াই বছরের মধ্যে সন্তানদের বিক্রি করলেও মর্জিনার অভাবের কপাল এখনো খোলোনি।
সরেজমিনে জানা যায়, বিক্রি করা কন্যা সন্তানরা ওই দম্পতির পঞ্চম ও ষষ্ঠ সন্তান। বর্তমানে ওই দুজনের বয়স যথাক্রমে দুই মাস ও দুই বছর। জন্মের পরেই তাদেরকে বিক্রি করে মর্জিনা দম্পতি। তাদের বিক্রি করে মোট ২৩ হাজার টাকা পেয়েছিলেন তারা। তাদেরকে কুড়িগ্রাম সদরের যাত্রাপুর ও খলিলগঞ্জ এলাকায় বিক্রি করা হয়।
সন্তান বিক্রি করা প্রসঙ্গে মর্জিনা বেগম বলেন, ‘অভাবের কারণে বাচ্চা দুইটাকে পোষানি দিছং। মুই পঙ্গু, মোর স্বামীও পঙ্গু। কামাই করবার পাই না তাই কোলের দুইটা ছাওয়াক পোষানি দিছং। যে টাহা পাইচং তাও শ্যাষ। এলা বাকি বাচ্চাগুলাক কি খায়্যা বাচাং।’
মর্জিনার প্রতিবেশী বানেছা বলেন, ‘অভাবের কারণে তারা দুইটা বাচ্চা পোষানি দিছে। কী করবে, ভাত কাপড় দিবের পায় না। মর্জিনার হাত-পা অবশ। উয়ার ভাতার তো পাগলা জোগলা মানুষ। কামাই কইরবার পায় না খায় কী।’
একই এলাকার জিয়াউর রহমান বলেন, ‘খলিলের জমি জমা নাই, সরকারের দেয়া গুচ্ছ গ্রামে থাকে। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কাজ করবার পায় না। আশপাশের লোকজন যা দেয় তা-ই খায়। মাঝে মধ্যে চেয়ারম্যান-মেম্বার কিছু দেয়। এ ছাড়া খলিলের শ্বশুর মাসে কিছু ধান চাউল দিয়ে সহযোগিতা করে। বাচ্চাগো ভরণপোষণ করবের না পাইরা দুডা বাচ্চাক বেঁচে খাইছে।’
বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মঞ্জু হোসেনের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঘটনা শোনার পর সংযোগটি কেটে দেন।
এ বিষয়ে উলিপুর উপজেলার চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন মন্টু সরকার বলেন, ‘আপনাদের মাধ্যমে জানতে পারলাম বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের খলিল দুটো কন্যা সন্তানকে বিক্রি করেছে। এটা দুঃখজনক ব্যাপার। ডিজিটাল বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী গৃহহীন ও অভাবী মানুষের জন্য কাজ করছে। ওই ইউনিয়নের মেম্বার-চেয়ারম্যানদের উচিত ছিল তাদের পাশে দাঁড়ানোর। তারা পাশে না থাকলে আমাকে জানাতো আমি দ্রুত ব্যবস্থা নিতাম।
উলিপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নূরে জান্নাত রূমি বলেন, বিষয়টি শুনেছি। খোঁজ নিতে লোক পাঠিয়েছি। বিস্তারিত জেনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ‘সরেজমিন পরিদর্শন করে এ বিষয়ে মন্তব্য করব।’