১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন, ৪৯ বছর পর শনিবার, ৭ মার্চ সেই রেশ ফিরে এলো আর্মি স্টেডিয়ামে।
ক্ষণিকের জন্য স্টেডিয়ামটি পরিণত হলো রেসকোর্স ময়দানে। উপস্থিত দর্শকদের মনে হচ্ছিলো, হাত বাড়ালেই বুঝি ছোঁয়া যাবে ৭৫-এ হারিয়ে ফেলা প্রাণের বঙ্গবন্ধুকে।
শনিবার আর্মি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত জয় বাংলা কনসার্টে ১১ ব্যান্ডের পরিবেশনার মাঝে বিশেষ চমক হিসেবে প্রদর্শিত হয় ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের থ্রিডি হলোগ্রাম। রাত সাড়ে ৮টার নানা বিস্ময়ের মধ্য দিয়ে প্রদর্শিত হয় এই প্রেজেন্টেশন। যার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু হাজির হয়েছিলেন প্রায় জীবন্তরূপে, সবার চোখের সামনে।
ব্যান্ড লালনের পরিবেশনা শেষে এই হলোগ্রাম চমকের শুরুটা হয় কবি নির্মলেন্দু গুণের বিখ্যাত কবিতা ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’ থেকে আবৃত্তির মধ্য দিয়ে। কবিতাটি শেষ হতেই মঞ্চে হাজির হন হলোগ্রাফিকরূপে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। উপস্থিত প্রতিটি মানুষই ধরে নিয়েছেন তারা দুজন বাস্তবেই হাজির। দুজনার মুখে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ৩২ নম্বর সড়কের বাড়ির পরিস্থিতি, তাঁদের মা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের দূরদর্শী পরামর্শের স্মৃতিচারণ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কণ্ঠে কবিতার শেষ ক’টি লাইনের আবৃত্তি পুরো পরিবেশকে এক অন্যমাত্রায় নিয়ে যায়। এরপর হঠাৎ মঞ্চ থেকে ফিনিক্স পাখির মতো মিলিয়ে যান দুই বোন, পলকেই সবার সামনে হাজির হন বঙ্গবন্ধু! শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর রেসকোর্স ময়দানের সেই ভাষণ, যা দেখে বোঝার কোনও উপায় ছিল না—বাস্তবে নয়, এটি চলছে পর্দায়!
পুরো প্রজেকশন শেষে সবাইকে আরেকবার চমকে দেন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা সরাসরি অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত থেকে। প্রজেকশন শেষে বাস্তবে তাঁদের উপস্থিতি দেখে অনেকেই বিভ্রমে পড়েন—সত্যি! নাকি এটাও হলোগ্রাফিক চমক।
অনুষ্ঠানে আগত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মুস্তাফিজ আহমেদ হা-হয়ে পুরো বিষয়টি দেখছিলেন। শেষ হওয়ার পর নিজের ডানে-বামে তাকালেন বিস্ময়ভরা চোখে। বাংলা ট্রিবিউন প্রতিবেদককে বললেন, ‘এ কী দেখলাম! বাস্তব না ভিডিও! মনে হলো বঙ্গবন্ধুকে সরাসরি দেখলাম। অবিশ্বাস্য বিষয় মনে হলো।’
আরেক দর্শক মোহাম্মদ সাদ বলেন, ‘জীবনে অনেক থ্রিডি ছবি দেখেছি, সেগুলোকে বাস্তব লাগেনি। এমন জীবন্ত প্রজেকশন প্রথম দেখলাম। মনে হলো আমরা রেসকোর্স ময়দানেই দাঁড়িয়ে আছি।’
জানা গেছে, বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো এমন হলোগ্রাফিক প্রজেকশন হলো। সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের উদ্যোগে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের ২৩টি উক্তির সমন্বয়ে এই থ্রিডি হলোগ্রাম তৈরি হয়েছে। সবার মধ্যে স্বাধীনতার চেতনাকে উজ্জীবিত করা এবং ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করা এই হলোগ্রামের উদ্দেশ্য।
হলোগ্রাফিক প্রজেকশনে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাএই প্রকল্পটির ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করেছেন সংগীতশিল্পী হাসান আবিদুর রেজা জুয়েল। তিনি জানান, পুরো প্রজেক্টের পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছেন জুলফিকার রাসেল। ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এন.ডি.ই. সল্যুশন লিমিটেড এই হলোগ্রাফিক প্রযুক্তির কারিগরি সহযোগিতা দিয়েছে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের তত্ত্বাবধানে এই হলোগ্রাম নির্মাণ করেছে ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড। টেকনোলজি ও নলেজ পার্টনার এমডিএইচ হলোগ্রাম। আবৃত্তি করেছেন মাহিদুল ইসলাম, সংগীত/শব্দ সংযোজনায় ইফতেখার আনাম, অ্যানিমেশন সাজিয়েছেন মানিক দাস। ১৯৭১ সালের ফন্ট পুনর্ডিজাইন করেছেন আবুল হোসেন খোকন। অনুবাদ করেন সাগুফতা শারমীন তানিয়া। স্থানীয় কারিগরি কনসালট্যান্ট ছিলেন তৌফিক রহমান। ইভেন্ট প্রজেকশন তত্ত্বাবধান করেছেন এম এন ইসলাম নায়িম।
এন.ডি.ই. সল্যুশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিয়াদ এস.এ. হোসেইন বলেন, ‘‘হলোগ্রাফি হচ্ছে এমন এক ধরনের ফটোগ্রাফিক প্রযুক্তি, যা কোনও বস্তুর ত্রিমাত্রিক ছবি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। এ প্রযুক্তিতে তৈরি করা ত্রিমাত্রিক ছবি ‘হলোগ্রাম’ নামে পরিচিত। হলোগ্রাম প্রযুক্তির সর্বশেষ চমৎকারিত্ব হলো থ্রিডি হলোগ্রাম প্রজেকশন, যা থ্রিডি চশমা ছাড়াই সবার কাছে দৃশ্যমান।’’
প্রকল্পটির ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর হাসান আবিদুর রেজা জুয়েল জানান, এই থ্রিডি হলোগ্রাম আবারও লাইভ প্রদর্শন করা হবে আগামী ১৯ মার্চ জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিতব্য শিশুমেলায়। এরপর দেখানো হবে ২০২১ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিতব্য ‘তথ্য প্রযুক্তি সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কংগ্রেস ২০২০’-এ। এরপর এই হলোগ্রাম স্থায়ীভাবে রাজধানীর ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের শেখ লুৎফর রহমান ও শেখ সায়েরা খাতুন প্রদর্শনী গ্যালারি থিয়েটারে স্থাপন করা হবে।
এদিকে শনিবার দুপুর থেকে বনানীর আর্মি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত জয় বাংলা কনসার্টে আগত প্রায় ৫০ হাজার দর্শক মেতে ওঠেন এই প্রজন্মের রক ব্যান্ডগুলোর পরিবেশনায়। বঙ্গবন্ধুর উল্লেখযোগ্য উক্তি, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান আর ব্যান্ডের মৌলিক পরিবেশনার মধ্যে বাড়তি চমক দেয় হলোগ্রাফিক রিপ্রেজেন্টেশনটি।
এবি/রাতদিন