কচুপাতায় চলে শান্তিবানুর জীবন

শেখ আবদুল আলিম ॥ ৮০ বছরের বৃদ্ধার নাম শান্তি বানু। স্বামী অনেক আগে চলে গেছেন। বতর্মানে তার খোঁজ কেউ রাখে না। তিন সন্তান থাকার পরেও এ বয়সে নিজের খাবারের জোগাড় করতে হয় নিজেকেই। তাইতো রাস্তার ধারে গজানো কচুর পাতা সংগ্রহ করে এগুলো বিক্রি করেন শহরের অভিজাত হোটেল-রেস্তোরায়। এ থেকে যা’ পান আর পরিচিতজনদের সাহায্য সহানুভুতিতেই চলে শান্তি বানুর কষ্টের জীবন।

শান্তিবানুকে চেনেন ছোট্ট শহরের অনেকেই। থাকেন লালমনিরহাট শহরের অদূরে শহীদ শাহজাহান কলোনীর একটি ছোট্ট ঝুপড়ি ঘরে। তিন যুগ আগে কলোনীতে চার শতাংশ ভূমিতে ঘর করে দেন সরকার।

শান্তিবানু ও স্বামী রইছুদ্দিনের ছিল স্বপ্ন, ছিল বুকভরা আশা। ছেলেরা বড় হবে। টাকা রোজগার করবে। সংসারে সুখ আসবে, শান্তি আসবে শান্তিবানুর ঘরে। কোন কষ্ট থাকবেনা। কিন্তু, শান্তিবানুর শান্তির স্বপ্ন ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। স্বামী মারা গেছেন বছর দশেক আগে। ছেলেরা বড় হয়েছে।

তিন ছেলে শফিক, সুজন, শাহিন বিয়ে করেছে। তাদের সংসারে সন্তান এসেছে। এরই মধ্যে ছেলেরা সংসার পৃথক করেছে। যার যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত তারা। খোঁজ রাখেনা বৃদ্ধা মায়ের। খেয়ে না খেয়ে চলে শান্তিবানুর কষ্টের জীবন। ভিক্ষা তিনি করেন না। তবে পরিচিতজনরা অনেকে পাঁচ দশ টাকা দেন। এভাবে আর কতদিন চলবে !

শহীদ শাহজাহান কলোনীতে সরেজমিনে গেলে সংবাদ কর্মীদের সাথে শান্তিবানুর দেখা হয়। তার সাথে আলাপচারিতায় এসব কষ্টের কথা জানান তিনি। দেখা হয় রমিচা, গুলজান, আমেনা, রহিতনের সাথে। তাদের প্রত্যেকের জীবনে একটা করে আলাদা গল্প আছে। আছে করুণ ইতিহাস।

এ প্রতিবেদক শান্তিবানুর তিন ছেলের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাদেরকে বাড়িতে পাওয়া যায়নি। কাজে চলে গেছেন। কথা হয় বউদের সাথে। তারা জানান ভিন্ন কথা। মুঠোফোনে কথা হলে বড় ছেলে শফিক বলেন, ‘আমার সংসার চলেনা। ছেলেমেয়ের ভরণপোষণ করাই কঠিন অবস্থা। মায়ের ছেলে আমি কি একা ? আরোতো আছে। ’ কথাগুলো বলা শেষ হতে না হতেই ফোন কেটে দেন তিনি।

রমিচা, গুলজান, আমেনা, রহিতনের সাথে শান্তি বানু

সরকার আইন করেছে, বাবা-মাকে সন্তানরা লালন পালন করা বাঁধ্যতামূলক। তা’ না হলে ওই সন্তানকে জেলে যেতে হবে। জেলের কথা শুনে বৃদ্ধা শান্তিবানু বিচলিত হয়ে উঠেন। তিনি বলেন,‘ আল্লাহর দোহাই লাগে, মোক ভরণ-পোষণ না করুক, তেবু বেঠাগুলাক জেলত না দেন।’ বলতে বলতে এগিয়ে এল। হাতজোড় করে বৃদ্ধা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। সন্তানের প্রতি মায়ের আবেগময় কথাগুলো সবার হৃদয়-মন এফোঁড়- ওফোঁড় করে দেয়।

এ বয়সে শান্তিবানুর কাজ করা মানায় না। চোখে কম দেখেন। কচুপাতা কুড়ানো ছাড়া আর কোন কাজই যে তার পক্ষে সম্ভব নয়! বয়স্কভাতার পাঁচশ’ টাকা আর কচুপাতা কুড়ানো কষ্টের জীবন আর কতদিন চলবে! সিক্ত চোখের জল মিশে থাকে কুড়ানো কচুপাতায় প্রতিদিন-প্রতিক্ষণ..।

শহীদ শাহজাহান কলোনীতে রয়েছে আটশতাধিক পরিবার । রয়েছে তিন হাজারের অধিক ভোটার। এখানে বাস করেন পাঁচ হাজারের বেশী মানুষ । ভেঙ্গেপড়া পয়নিষ্কাশন ও স্বাস্থ্য সেবা। নারী এবং মেয়েদের অধিকার সুরক্ষার কোন বালাই নেই। বাল্য বিয়ে প্রতিরোধে নেই কোন উদ্যোগ। তবুও শান্তি বানুদের প্রশান্তিময় জীবন খুঁজে পায় জীবনের ঠিকানা।

এনএ/রাতদিন