যৌন সন্ত্রাস রোধে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক জাগরণ জরুরি

সামাজিক মূল্যবোধের চূড়ান্ত অবক্ষয়ের দৃষ্টান্ত যৌন নিপীড়ন। বৃদ্ধ থেকে শিশু—সব বয়সের নারী যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। প্রতিনিয়ত খুন, ধর্ষণ, নির্যাতন বাড়ছে। খুবই উদ্বেগজনক বিষয় যে শিশুর প্রতি সহিংসতা ও যৌন নির্যাতন চরম সীমা অতিক্রম করেছে। ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, শুধু প্রশাসন নয়, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নয়, নিপীড়নের বিরুদ্ধে ও নিপীড়কের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন করতে হবে। যৌন সন্ত্রাস রোধে মানুষের মধ্যে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক জাগরণ জরুরি। সঠিক শিক্ষা ও সংস্কৃতি বোধ মানুষের মধ্যে জাগ্রত করতে পারলে অনেক অনাচার থেকে দেশ মুক্তি পাবে।

পত্রিকায় ও টেলিভিশনে যখন শিশু ধর্ষণের খবর শুনি, তখন স্তব্ধ হয়ে পড়ি। কোথায় যাচ্ছে আমাদের শিক্ষা? কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের বিবেক? চার বছরের শিশুকে কোন সাহসে ৬০ বছরের বৃদ্ধ ধর্ষণ করে? ধর্ষক শুধু ক্ষমতার চর্চা করে না, একই সঙ্গে বিকারগ্রস্ত ও নারীলিপ্সু। আমরা তার মধ্যে মানবিকতা, মূল্যবোধ, সংস্কৃতি বোধ জাগ্রত করতে পারিনি। সাম্প্রতিক সময়ে স্কুল-কলেজ, মাদরাসাসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ওপর যৌন নিপীড়ন বেড়েছে। শিক্ষকরা যখন ধর্ষক হয়ে ওঠে, যৌন নির্যাতন করে, তখন বুঝতে হবে দেশে শুরু হয়ে গেছে চূড়ান্ত অবক্ষয়।

একজন শিক্ষকের প্রধানতম কাজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিবেক, নৈতিকতা, দেশপ্রেমসহ মানবিক গুণাবলির উন্মোচন করা। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে আদর্শ ও শ্রদ্ধার যে সম্পর্ক, তাতেও ফাটল ধরেছে। মাদরাসার শিক্ষক, যাঁর কাজ ধর্মীয় শিক্ষাদান, শিক্ষার্থীদের নৈতিক ও আত্মিক উন্নয়ন করা, তিনি যদি ধর্ষক হন আমরা কোথায় যাব? শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, ঘরে-বাইরে সর্বত্রই নারী নির্যাতন বৃদ্ধি পেয়েছে। নারী ও শিশু ধর্ষক ও যৌন নিপীড়কদের বিরুদ্ধে সবার ঐক্যবদ্ধ হতেই হবে। সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি ধর্ষক ও নিপীড়কদের দ্রুত বিচারের আওতায় এনে কঠিন ও কঠোর শাস্তি দিতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যৌন নিপীড়ন ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছেন। পুলিশ প্রশাসনও তৎপর রয়েছে। তার পরও কেন যৌন সস্ত্রাস কমছে না, সমাজ থেকে নির্মূল হচ্ছে না তা খুঁজে বের করতে হবে। যৌন সন্ত্রাস, মৌলবাদ, উগ্রবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি সমস্যার মূলেই রয়েছে আধিপত্যবাদ, ক্ষমতার অপচর্চা ও মানবিকতা ও মূল্যবোধের অভাব। যার ভেতর বিবেক থাকে, মূল্যবোধ থাকে, মানুষের প্রতি ও পৃথিবীর প্রতি প্রেম-ভালোবাসা থাকে, কখনো সে খুন করতে পারে না। একজন বিবেকবান মানুষ কখনো ধর্ষণ করতে পারে না।

শিল্প-সংস্কৃতি, সাহিত্য-সংগীত মানুষের মনন তৈরি করে, বিবেক জাগ্রত করে। আমাদের দেশে সংস্কৃতিচর্চা কমে যাচ্ছে। মানুষের ভেতর যদি বিবেক জাগ্রত না হয়, মানুষের মধ্যে যদি মানবতা ও মমত্ববোধ জাগ্রত না হয়, পুলিশ ও প্রশাসন কতটুকু আর যৌন নিপীড়ন রোধ করতে পারবে? সঠিক শিক্ষা ও সংস্কৃতিচর্চা আমাদের বিবেক ও মানবতাবোধ, সততা ও আন্তরিকতাবোধ তৈরি করে। আমার মনে হয়, সারা দেশে শিক্ষা ও সংস্কৃতির জাগরণ ছাড়া অবক্ষয় রোধ করা সম্ভব নয়।
লেখক : সেলিনা হোসেন, কথাসাহিত্যিক
সূত্র : সোমবার, ৮ জুলাই কালের কন্ঠে প্রকাশিত লেখাটি হুবুহু তুলে ধরা হয়েছে।